গরিবের শান্তি নাই

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও মূল্যবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে থাকায় কম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় চাপ বাড়ছে। ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় যেন তাদের সেই হতাশার চিত্রই ফুটিয়ে তোলে। মঙ্গলবার মোহাম্মদপুর বাসস্টেশন থেকে ছবিটি তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী প্রবীর দাশ।

গত এক বছরে সামগ্রিক অর্থনীতির লক্ষ্যন ভালোর দিকে গেলেও ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করা ট্রাকের পেছনে মানুষের ভিড় কমেনি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নতির আড়ালে ক্ষুধা এখনো তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরে আছে নিম্নআয়ের মানুষকে।

ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয় সকাল ৯টার দিকে। কিন্তু, না পাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকে লাইনের শুরুর দিকে দাঁড়াতে ভোর থেকেই মানুষ চলে যায় ট্রাকের অপেক্ষায়, দীর্ঘ হতে থাকে সারি।

প্রচণ্ড গরম কিংবা ভারী বৃষ্টি—তারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে লাইনে। ঠেলাঠেলি, তর্ক, ঝগড়া, এমনকি মারামারি করে হলেও সামনের দিকে থাকা নিশ্চিত করতে চায় শুধু বাজারদরের চেয়ে একটু কম দামে চাল, ডাল, তেল পাওয়ার জন্য। প্রথম দিকে মানুষগুলোকে পণ্য দিতে দিতে ট্রাক খালি হয়ে যায়, লাইনের একটু পেছনে পড়া অনেককে ঘরে ফিরতে হয় খালি হাতে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৯৫ লাখ—যা এ বছর পৌঁছাবে ১ কোটি ৫০ লাখে। যাদের দৈনিক আয় ২ ডলার ১৫ সেন্ট (প্রতি ডলারের দাম ১২১ টাকা হিসাবে প্রায় ২৬০ টাকা) বা তার কম, তাদের জন্য দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি মানে হলো ক্ষুধা, আর অনেক ক্ষেত্রে অনাহার।

এই গোষ্ঠীর চেয়ে একটু ভালো যারা যারা আছে—অর্থাৎ, যাদের আয় এই শ্রেণীর চেয়ে একটু বেশি—তারা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কোপ বসাতে বাধ্য হয়েছেন প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। পুষ্টি কমিয়েছে, চিকিৎসা খরচ এড়িয়েছে, এমনকি অনেকে সন্তানদের স্কুল পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছেন। এগুলোকে আষাঢ়ে গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একটু চোখ মেললেই এর সত্যতা পেয়ে যাবেন যে কেউ।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাসিন্দা মাসুদ রানার কথাই ধরা যাক। স্ত্রী, তিন সন্তান ও মাকে নিয়ে তার সংসার। তিনি রাজধানীতে প্যাডেল রিকশা চালান। গত ২০ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন।

৩৩ বছর বয়সী রানা গত মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত এক বছরে খরচের সঙ্গে আয়ের তাল মেলাতে না পেরে তাকে দৈনন্দিন চাহিদা কমাতে হয়েছে।

তিনি মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা উপার্জন করেন। 'কয়েক বছর আগেও সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন মাছ খেতাম। তেলাপিয়া, সিলভার কার্প, ছোট মাছ—কোনো না কোনোটা কিনতে পারতাম। কিন্তু এখন সপ্তাহে দুদিন মাছ খেতেও কষ্ট হয়।'

তিনি জানান, বেশিরভাগ দিন তার ঘরে লাউ, আলুর মতো সবজি রান্না হয়।

শিক্ষাবর্ষের শুরুতে সন্তানদের স্কুলের নতুন পোশাক কিনে দিতে পারেননি রানা। মাসখানেক আগে স্ত্রী নতুন একটি থ্রি-পিস চেয়েছিলেন, সেটাও কিনতে পারেননি। 'রিকশা চালাইতে অনেক কষ্ট হয়। বিশ্রাম তো নিতে পারি না। খাওয়ার অবস্থাও ভালো না। পুষ্টি পাই না। শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখাব, তাও পারি না।'

ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সামিউল ইসলামের চাপ ভিন্ন ধরনের। কিন্তু, সার্বিকভাবে একই বাস্তবতা তার সামনেও।

মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা এই মানুষটি জানান, সব কম প্রয়োজনীয় খরচ বাদ দেওয়ার পরও মাসের শেষে তাকে ঋণ করতে হয়।

তিনি বলেন, 'আগে আমরা মাসে অন্তত একবার বাইরে খেতে যেতাম। সেই বিলাসিতা তো কবেই ছাড়তে হয়েছে। অনেক দিন পর ঢাকার বাইরে একটু ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু টাকায় মেলাতে পারলাম না।'

সিরাজগঞ্জের গারুদাহা গ্রামের পাওয়ারলুম শ্রমিক ওমর ফারুকের মাসিক আয় প্রায় ৮ হাজার টাকা। নিজের কোনো জমি নেই। তিনি পুরোপুরি কারখানার মজুরির ওপর নির্ভর করে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে সংসার চালান।

ফারুক বলেন, 'যা ইনকাম করি, বেশির ভাগই চাল-ডালসহ খাবারের পেছনে। কিছু জিনিসের দাম গত বছরের চেয়ে কমেছে। কিন্তু, তারপরও দামের যে অবস্থা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়, বাবা-মাকে আর কিছু দিতে পারি না। মেয়েটার ভবিষ্যতের জন্য কয়টা টাকা রাখব, সেটা তো ভাবতেও পারি না।'

রাজধানীর মিরপুর-১১ এলাকার গার্মেন্টস কর্মী দারুল হুদা মাসে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করেন। তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন ছোট ভাড়া বাসায়।

হুদা বলেন, 'গ্রামেও আমার কোনো জায়গা-জমি নাই। প্রতি বছরই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। কোনো স্বস্তি পাই না।'

উচ্চ মূল্য, বাড়ছে দারিদ্র্য

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৫৫ শতাংশে। জুনে এই হার ছিল ৮.৪৮ শতাংশ।

খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি জুনে ছিল ৭.৩৯, যা জুলাইয়ে বেড়ে হয়েছে ৭.৫৬ শতাংশ। অথচ, গত বছরের নভেম্বর থেকে টানা খাদ্য মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমছিল।

প্রতি বছর যে হারে বেতন বা মজুরি বাড়ে, খরচ বাড়ে তার চেয়ে বেশি। পরপর ৪২ মাস ধরে প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। জুনে মজুরি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.১৯ শতাংশ, যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৫৫ শতাংশ।

এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক প্রাক্কলন করেছে, বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্য ২০২২ সালে ছিল ১৮.৭ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২২.৯ শতাংশে। চরম দারিদ্র্য, অর্থাৎ দৈনিক ২ ডলার ১৫ সেন্টের কম আয়ে জীবনযাপনকারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৯.৩ শতাংশ হবে এবং এর ফলে আরও অন্তত ৩০ লাখ মানুষ নিঃস্ব হবে।

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদন ২০২৫ অনুযায়ী, গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে থাকা মানুষের সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, জলবায়ুজনিত ধাক্কা, উচ্চ আমদানি খরচ এবং দুর্বল সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাই এর প্রধান কারণ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ অনেক দিন ধরেই রয়েছে। গত এক দশকের সূচকগুলো—বিশেষত ক্ষুধা সূচক—দেখলে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ভালো করতে পারেনি।'

তিনি বলেন, 'শুধু বাজারে খাদ্য থাকলেই সেটাকে খাদ্য নিরাপত্তা বলা যাবে না। মানুষের প্রয়োজন চাকরি এবং প্রকৃত আয় বৃদ্ধি।'

তিনি বলেন, 'নিঃসন্দেহে বলা যায়, খাদ্য নিরাপত্তা অবনতির দিকে গেছে। গত দু-তিন বছরে আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ ও প্রাক্কলনও একই চিত্র দেখাচ্ছে। দরিদ্রতম মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আরও খারাপ হয়েছে।'

২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার প্রায় সাড়ে ৩২ লাখ টন খাদ্যপণ্য ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করেছে, যা আগের বছরের প্রায় সমান। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রায় এই পরিমাণ বাড়িয়ে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার টন ধার্য করা হয়েছে।

গত জুলাইয়ে খাদ্য বিতরণ কমে ১ লাখ ৬৫ হাজার টন থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। অনিয়মের অভিযোগের পর চালের ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে, এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি থেকে ৫৫ লাখ থেকে কমে গেছে।

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো অস্বস্তিকর রকমের বেশি উল্লেখ করে অধ্যাপক সেলিম বলেন, 'মোটাদাগে মূল্যস্ফীতি কিছুটা প্রশমিত হলেও খাদ্যের দাম উচ্চই রয়ে গেছে।'

তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে, শ্রীলঙ্কায় এটা ঋণাত্মক। পাকিস্তান ও নেপালেও মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম।

'বিশ্ববাজারে চালসহ খাদ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও তার প্রতিফলন দেশের বাজারে নেই। মূল্যস্ফীতি কমলেও চাল ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম না কমায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। গত এক বছরে এই অবস্থার বড় কোনো উন্নতি হয়নি।'

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia contribution to Bangladesh democracy

A leader who strengthened our struggle for democracy

Khaleda Zia leaves behind an enduring legacy of service.

13h ago