‘দেখ দেখ জাহিদ হাসান’

একযুগেরও বেশি সময় আগের কথা। এক প্রচণ্ড গরমের দিন প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম সিরাজগঞ্জ শহরে—জাহিদ হাসান পরিচালিত একটি ধারাবাহিকের শুটিং দেখতে। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় মাইক্রোবাসে মীর সাব্বিরসহ আমরা বেশ কয়েকজন একসঙ্গে যাত্রা করি।
মাঝ রাস্তায় মাইক্রোবাসের চালকের চোখে ঘুম দেখে মীর সাব্বির নিজেই চালালেন। সিরাজগঞ্জে গিয়ে আমরা উঠলাম এক হোটেলে। জাহিদ হাসান আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, 'সাজু এসেছ! খুব ভালো করেছ। এটাই আমার নিজের শহর।' এরপর মীর সাব্বিরকে বললেন, 'কী খবর সাব্বির? আছিস কেমন?' এক এক করে সবার খোঁজ নিলেন। তারপর লাঞ্চ করে শুরু হলো আড্ডা।
আজ ৪ অক্টোবর জাহিদ হাসানের জন্মদিন। হঠাৎ করেই স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো জাহিদ হাসানের সেই শুটিংয়ের স্মৃতিগুলো। তার সঙ্গে আমার স্মৃতি অনেক—বেশিরভাগই শুটিংকেন্দ্রিক।
নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান—আজও সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। অসংখ্য টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। আলোচিত হয়েছে তার অভিনীত বহু নাটক। বেশ কয়েকটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন তিনি। 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'হালদা' ও 'সাপলুডু' সিনেমা তাকে এনে দিয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
সিরাজগঞ্জে সে নাটকের শুটিংয়ের কথা বলছিলাম, সেটার চিত্রগ্রহণে ছিলেন আনোয়ার হোসেন বুলু। তার বাড়িও সিরাজগঞ্জে। জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি নাটকটিতে সিরাজগঞ্জ শহরের কয়েকজন মঞ্চকর্মীও অভিনয় করেছেন।
আমরা যাওয়ার পরদিন শুটিং শুরু হবে। সিরাজগঞ্জ শহরের একটি বাড়িতে চলে গেলেন সবাই। জাহিদ হাসানের সঙ্গে গেলাম আমরা কয়েকজন। যাওয়ার সময় জাহিদ হাসান বললেন, 'এই শহরেই পড়ালেখা করেছি। আমার স্কুল-কলেজ এই শহরে। মঞ্চ নাটকের শুরুটাও এখানে।'
গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে যাই দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ির সামনে। দোতলায় ড্রয়িংরুমে বসি। জাহিদ হাসান ও সাদিয়া ইসলাম মৌয়ের একটি বড় ছবি চোখে পড়লো দেয়ালে। জাহিদ হাসান বললেন, 'এটাই আমাদের বাড়ি।'
নাটকের সহকারী পরিচালক ইমরান এসে বললেন, 'জাহিদ ভাই, সেট রেডি।' জাহিদ হাসান বললেন, 'তুমি যাও, আমরা আসছি।'
শুটিংয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আরও কিছুক্ষণ আড্ডা চলল। জাহিদ হাসানের ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ এলেন, আড্ডা জমালেন। জাহিদ হাসান বললেন, 'তোমরা এসেছ খুব খুশি হয়েছি।'
কেউ একজন বললেন, 'আপনার নাটকে অভিনয় করতে চাই।' জাহিদ হাসান বললেন, 'অসুবিধা নেই, করবে। মঞ্চে কাজ করো তো তাই না?' তিনি বললেন, 'জ্বি ভাই।'
এরপর জাহিদ হাসান নিচে নামলেন। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন বুলু। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন মীর সাব্বির ও রুমানা। জাহিদ হাসান দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়ে মনিটরের সামনে বসলেন।
রোমানা স্ক্রিপ্ট পড়ে নিলেন। অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে সংলাপ দিতে শুরু করলেন রোমানা ও মীর সাব্বির। খুব সহজেই দৃশ্যটি ধারণ করা হলো।
পরের দৃশ্যে জাহিদ হাসানও অভিনয় করবেন। তিনি ভেতরে গিয়ে পোশাক বদলে এলেন। দৃশ্যটি ধারণ করা হবে বাড়ির পাশের রাস্তায়। রাস্তা দিয়ে রিকশা চলাচল করছে বলে সবকিছু রেডি করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া, মানুষজনও ভিড় করছে জাহিদ হাসানকে দেখার জন্য। একটু সময় লাগল সবকিছু ঠিক হতে।
এবার জাহিদ হাসান হেঁটে আসছেন। দৃশ্যটি করতে বেশি সময় লাগল না। আবারও রাস্তায় শুটিং হবে। একটু পরপর রিকশা যাচ্ছে, মানুষজনও ভিড় করছে। কয়েকজন বলেই ফেললেন, 'দেখ দেখ জাহিদ হাসান।' কেউ একজন বললেন, 'শুটিং হচ্ছে প্লিজ।'
দুপুর হয়ে এলো। সহকারী পরিচালক জানালেন, পরের দৃশ্য করবেন যমুনা নদীর পাড়ে। জাহিদ হাসান বললেন, 'লাঞ্চ বিরতি দাও।' খাওয়ার সময় জাহিদ হাসান তদারকি করছিলেন, সবাই ঠিক মতো খাচ্ছে কিনা। খাওয়া শেষে বাসার নিচে কিছু সময় আড্ডা দিলেন। এরপর যমুনা নদীর পাড়ে শুটিং।
শুটিং ইউনিট চলে যাওয়ার পর জাহিদ হাসানসহ বাকি সবাই গেলেন। নদীর পাড়ে সেট রেডি হচ্ছে, অন্যদিকে জাহিদ হাসানকে দেখতে ভিড় করছেন অনেকেই। তাদের কথা শুনে জাহিদ হাসান হাসছেন। কয়েকজন এলেন ছবি তুলতে। সানন্দে রাজি হলেন তিনি। ছবি তুলে চলে যাওয়ার সময় কেউ একজন বললেন, 'জাহিদ হাসান কিন্তু সিরাজগঞ্জের মানুষ।'
সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শুটিং চলল নদীর পাড়ে। সন্ধ্যার পর সিরাজগঞ্জ শহরের একটি বাড়িতে সেট ফেলা হলো। সেখানেও অনেক মানুষ ভিড় করলেন শুটিং দেখতে—মূলত জাহিদ হাসানকে দেখতে। উঠান থেকে উঁকি দিয়ে কয়েকজন বললেন, 'ওই যে জাহিদ হাসান।'
শুটিং শেষ করে রাতের বাসে ফিরব। জাহিদ হাসান জোর করে তার ইউনিটের একজনকে দিয়ে টিকিট কেটে দিলেন। শত চেষ্টা করেও আমি টিকিট কাটতে পারলাম না। মীর সাব্বির বললেন, 'কাজ হবে না সাজু। জাহিদ ভাই টিকিট কেটেই দেবেন।'
ফেরার সময় জাহিদ হাসান বললেন, 'ভালো থেকো। ঠিকভাবে তোমার খোঁজ নিতে পারিনি। ঢাকায় গিয়ে দেখা হবে।'
সিরাজগঞ্জ থেকে ফেরার পথে ভাবছিলাম, 'গিয়েছিলাম সিরাজগঞ্জ, জাহিদ হাসানের শহরে…।'
Comments