লাপাতা লেডিস: হাস্যরস-রোমান্সে নারীর নিজ গন্তব্য খুঁজে পাওয়ার গল্প

ছবি: সংগৃহীত

গত ২৬ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই আলোচনায় কিরণ রাও পরিচালিত সিনেমা 'লাপাতা লেডিস'। আমির খানের প্রযোজনায় বিপ্লব গোস্বামীর গল্প এবং স্নেহা দেশাইয়ের সংলাপ ও চিত্রনাট্যে ফিল্মি পাড়ায় ইতোমধ্যেই সাড়া জাগিয়েছে সিনেমাটি।

কমেডি ও ড্রামা ঘরানার 'লাপাতা লেডিজ' সিনেমার ভেতর সচেতনভাবে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক বার্তা। আছে নারীশিক্ষা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতির গল্পও। আড়ম্বরহীন, কিন্তু যথেষ্ট স্নিগ্ধতার সিনেমাটিতে প্রায় আনকোরা একঝাঁক অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় দর্শককে টেনেছে প্রবলভাবে।

চার থেকে পাঁচ কোটি রুপি খরচ করে বানানো সিনেমাটি বক্স অফিস থেকে এখন পর্যন্ত আয় করেছে প্রায় ২২ কোটির মতো।

'লাপাতা লেডিস' দিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর পর পরিচালনায় ফিরেছেন কিরণ রাও৷ ১২২ মিনিটের একটি গল্পের ছুতোয় বললেন অসংখ্য গল্প, ব্যবহার করলেন অগুনতি চিহ্ন ও রূপক। সংলাপের পরতে পরতে দ্বিতীয় সংলাপের আয়োজন করে তুলে ধরলেন আমাদের চেনা-পরিচিত সমাজ, টেনে আনলেন পারিবারিক (ও সামাজিক) মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি হাসিময় সূর্যকে।

ঝকঝকে বলিউডি ধারার বাইরে 'লাপাতা লেডিস' একটি অতি শক্তিশালী নীরবতার গল্প। 'লাপাতা লেডিস'কে একটি অতি স্বাভাবিক ডার্ক কমেডি বলা যায়, শুরুতে তারই অবতারণা করে কিরণ রাও টেনে আনলেন রোমান্টিকতা। ফ্যামিলি ড্রামার ভেতর একটু সাধারণ থ্রিলার, যা শেষমেশ গড়ালো মন শীতল করে দেওয়া উপসংহারে।

পরিচালক কিরণ রা ও প্রযোজন আমির খানের সঙ্গে সিনেমার অভিনেতারা। ছবি: সংগৃহীত

গল্প ও প্রাসঙ্গিক বার্তা

২০০১ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমায় দীপক কুমারের সঙ্গে বিয়ে হয় ফুল কুমারীর। বিয়ে পর্ব শেষে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে ভুল করে অন্য পুরুষের স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে যান দীপক। দুই সদ্য বিবাহিত নারীর হারিয়ে যাওয়া ও সস্থানে ফিরে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই 'লাপাতা লেডিসে'র গল্প৷

আক্ষরিকভাবেই এটা হতে পারতো দুজন হারিয়ে যাওয়া নারীর 'সস্থানে' ফিরে যাওয়ারই গল্প। কিন্তু পরিচালক কিরণ রাও গল্পটাকে প্রয়োজনীয় মশলায় ময়ান করে উপস্থাপন করেছেন বিবিধ স্যাটায়ারে, প্রতিটি দৃশ্যেই তিনি কোনো-না-কোনো উপাদানে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে আঘাত করেছেন সমাজকে, সমাজব্যবস্থাকে, পুরুষের আচরণ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে৷ এখানে লক্ষণীয় হলো দুই চরিত্রের নামই শুরুতে ফুল ও পুষ্পা দেখানো হয়।

ট্রেনে যাত্রাপথে একই বগিতে আরও অনেক সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে দেখা যায়। দীপকের পয়েন্ট অব ভিউতে দেখানো হয় (সেই সময়ের) বিয়ের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে যৌতুক আহরণ। কে কী পরিমাণ যৌতুক অর্জন করতে পারলো— এ যেন পুরুষের পুরুষত্বের মানদণ্ড! অন্য যাত্রীদের বাক্যবাণে জর্জরিত দীপক তার স্টেশনে নেমে যাওয়ার সময়ই আপাতদৃশ্যে একটি ভুল করে বসে—অন্যের বউকে নিজের বউ ভেবে বাড়ি ফেরে৷

ইন্সপেক্টর শ্যাম মনোহর চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসায় ভাসছেন রবি কিষাণ। ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে পুষ্পা কিংবা জয়া যেন দীপকের পরিবারে একটি আয়নার মতো, তার বরাতে আমরা দেখি বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক, একইসঙ্গে তীব্র বেদনার্ত ছেলে বউটিকেও দেখি যে কিনা স্বামীর অবর্তমানে একেবারে নীরব, হাসিঠাট্টার সঙ্গীনি হিসেবে পুষ্পাকে পায়। ধীরে ধীরে তার ছবি আঁকার লুকায়িত প্রতিভা দেখানো হয়৷ পারিবারিক ও সাংসারিক ব্যস্ততায় যে প্রতিভা ছিল ক্রমশ ক্ষীয়মান৷ আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, দীপকের মা তার শাশুড়িকে বলছেন—'শেষ কবে আমরা আমাদের পছন্দের খাবার রেঁধে খেয়েছি?'

দীপকের পরিবারের নারী সদস্যদের যেভাবে পর্দায় উপস্থাপন করা হয়েছে, তাকে একেবারে বাস্তবতা বিবর্জিত বলা যায় না। পরিবারে খাবার রান্না থেকে শুরু করে সব ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যে পুরুষের পছন্দ ও ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং সেটিই যে একসময় নীতি হয়ে দাঁড়ায়—নানান সংলাপে ও সংকেতে সিনেমায় তুলে ধরেছেন কিরণ রাও।

জয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রতিভা রত্না। ছবি: সংগৃহীত

সিনেমাটিতে সুনিপুণভাবে নারী চরিত্রগুলোর মধ্যকার সংলাপ ও বন্ধন দেখানো হয়েছে। 'নারীরাই নারীর শত্রু' এমন ধারণা সিনেমায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই আলোচিত হতে দেখা গেলেও এই সিনেমায় প্রকটভাবে উঠে এসেছে 'নারীরাই নারীর বন্ধু' এবং যেকোনো নারীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য নারীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সিনেমায় ফুল কুমারীর হারিয়ে যাওয়ার পর স্টেশনে পরিচিত হয় মঞ্জু মাইয়ের সঙ্গে। সিনেমায় মঞ্জু মাই এমন এক চরিত্র যিনি স্বামী, সন্তানের হাতে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। পরে নিজের মতো করে একটি চায়ের দোকান চালিয়ে একাই বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ফুলকে আশ্রয় দেন, তার কাজের জন্য পারিশ্রমিকও দেন। আত্মসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা কেন জরুরি, সে সম্পর্কেও তাকে বোঝান।

অন্যদিকে, জয়া অন্য নারীদের বোঝায় যে নিজের জন্যও পছন্দের খাবার রান্না করা যায়, নিজের জন্যও ছবি আঁকা যায়। ফুল কুমারীর ছবি এঁকে সেটি দিয়ে 'নিখোঁজ' পোস্টার না বানালে হয়তো ফুলকে কখনো খুঁজে পাওয়া যেত না।

দীপক কুমার চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্পর্শ শ্রীবাস্তব। ছবি: সংগৃহীত

সিনেমায় কিরণ রাও দুটি গোত্রের পুরুষ সদস্যকে এখানে উপস্থাপন করেছেন। প্রথম গোত্রের পুরুষটি সহযোগী মনোভাবের, তার কোনো প্রপঞ্চ নেই, যৌতুকের প্রয়োজনীয়তা নেই, সে তার সঙ্গীনিকে ভালোবাসে, যেকোনো মূল্যে সে তার সঙ্গীনির পাশে থাকতে চায়।

দ্বিতীয় গোত্রের পুরুষটি জাহেল, পীড়ক, সর্বৈব অভদ্র ও স্বার্থান্ধ। সে তার বিবাহিত বউকে আঘাত করতে দ্বিধা করে না৷ কিরণ রাও অত্যন্ত নিপুণ কারিগরের মতো উভয়পক্ষের পুরুষকে উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন—একজন নারীর সফল হওয়ার পেছনে পুরুষের ভূমিকাও কী অসাধারণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে।

কিরণ রাওয়ের সিনেমায় পথ হারানো নারীরা আবার পথ ফিরে পেয়ে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারলেও সিনেমার বাইরে আমাদের স্বাভাবিক সমাজের রাস্তায় কজন নারী ফিরতে পারছেন নিজেদের মনমতো গন্তব্যে? এই প্রশ্নটুকু সচেতনে উত্থাপন করতে পেরেছেন কিরণ রাও। স্বপ্নের পথ খোলা থাকেই, সেখানে আনাগোনার জন্য নারীদের প্রয়োজন নীরব না থেকে প্রশ্ন করা এবং বাইরে পা ফেলার সাহস রাখা।

ফুল কুমারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিতাংশী গোয়েল। ছবি: সংগৃহীত

অভিনয়, সংগীত ও অন্যান্য

ফুল কুমারী চরিত্রে নিতাংশী গোয়েল ও দীপক কুমার চরিত্রে স্পর্শ শ্রীবাস্তব দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। জয়া/পুষ্পা রাণী চরিত্রে প্রতিভা রত্নাকে নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা চলছে। এর আগে জিটিভির 'কুরবান হুয়া'সহ আরও কয়েকটি ধারাবাহিকে অভিনয় করে পরিচিতি পেয়েছিলেন ২৩ বছরের প্রতিভা।

অভিনয় করেছেন বলিউডের মায়েস্ত্রো সঞ্জয় লীলা বানসালির 'হীরামন্ডি' সিরিজে। তবে ইন্সপেক্টর শ্যাম মনোহর চরিত্রে অভিনয় করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ঝড় তুলে দিয়েছেন রবি কিষাণ। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—এই চরিত্রে অভিনয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন খোদ আমির খান নিজেই! কিন্তু অডিশনে আমিরকে পিছনে ফেলে চরিত্রটি বাগিয়ে নেন রবি। হতাশ করেননি কোনোভাবেই, তার শক্তিশালী অভিনয় দারুণভাবে টেনে নিয়ে গেছে সিনেমার গল্পকে।

রাম সম্পাতের মিউজিকে সিনেমার বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছে স্লামডগ মিলিওয়নিয়ার খ্যাত গায়ক সুখবিন্দর সিং। 'সাজনি' গানে মন মাতিয়েছে অরিজিৎ সিং, গেয়েছেন শ্রেয়া ঘোষাল ও সোনা মহাপাত্র।

রটেন টোমেটোজে শতভাগ ফ্রেশ স্কোর এবং আইএমডিবিতে প্রায় নয় হাজার দর্শকের ভোটে সাড়ে আট রেটিং পেয়েছে সিনেমাটি।

Comments

The Daily Star  | English

BNP sticks to demand for polls by December

In a meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night, the BNP restated its demands that the next general election be held by December and the government immediately announce a roadmap to that end.

6h ago