দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বাড়ছে

আসিয়ানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক
জাকার্তায় আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

কূটনীতিকদের চোখে চলতি বছরটি ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর জি২০ ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মতো আন্তর্জাতিক ও প্রভাবশালী সংগঠনের সভাপতিত্বের দায়িত্বে আছে ভারত।

পাশাপাশি, ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান তুলে ধরে অনেক দেশের কাছে প্রিয় হয়েছে নয়াদিল্লি। 

গত সোমবার চীনের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান রেষারেষির মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা 'আসিয়ান' দেশগুলোয় ভারতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।

এতে আরও বলা হয়, চলতি মাসে প্রকাশিত সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসোফ ইসহাক ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে—অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) ১০ সদস্য দেশের মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ভারতের অবস্থান তৃতীয়তে।

এই দেশগুলোর নাগরিকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের পর ভারতকে বেশি পছন্দ করেন।

প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের তুলনায় এ বছর ভারতের জনপ্রিয়তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ, গত বছরের ৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে তা ১১ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে।

৬ দেশ নিয়ে চালানো জরিপে ভারতের পেছনে আছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও দক্ষিণ কোরিয়া।

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইউএসআইপি) দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড্যানিয়েল মার্কি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, 'এই জরিপ থেকে যা পাওয়া গেছে তা আরও অর্থবহ হবে যদি ভারতের প্রতি সমর্থন পরবর্তীতে আরও বেড়ে যায়।' 

'সম্ভাবনার বছর'

প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি চলতি বছরকে ভারতের জন্য 'সম্ভাবনার বছর' হিসেবে মন্তব্য করে বলেছে, ২০২৩ সালটি ভারত শুরু করেছে বেশকিছু ইতিবাচক 'মোড়' নিয়ে।

প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বমঞ্চে আর্থ-রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এই বছরটি ভারতের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে তাদের কারখানাগুলো সরিয়ে ভারতে আনার সম্ভাবনা আছে।

মহাকাশ গবেষণায় ভারত বেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব সত্ত্বেও ভারত প্রথমবারের মতো মহাশূন্যে মানুষ পাঠাতে কাজ করছে। 

আসিয়ানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক
নয়াদিল্লিতে আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সংলাপের ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। ছবি: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের টুইটার থেকে নেওয়া

ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজিব রঞ্জন চতুর্বেদী সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ ভারতকে "হুমকি" মনে করে না, বরং তারা ভারতকে "শান্তিপূর্ণ" দেশ হিসেবে সমীহ করে।'

ভারতের শক্তিশালী অর্থনীতি ও সম্ভাবনার পাশাপাশি সীমানাবিরোধকে কেন্দ্র করে চীনের 'ফাঁদে' পা না দেওয়ার মানসিকতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নয়াদিল্লিকে নতুন উচ্চতায় এনেছে।

গত ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারত এখনো পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম দ্রুত-বিকাশমান অর্থনীতি। দেশটির ২০২২-২৩ সালের জিডিপি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

রাজিব রঞ্জন চতুর্বেদী জানান, গত বছর ভারত আসিয়ানের সঙ্গে সংলাপের ৩০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছে। আসিয়ানের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক এখন 'কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ' পর্যায়ে উন্নীত হওয়ায় তা সেই অঞ্চলে ভারতের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষণা বিশ্লেষক ক্লদিয়া চাই মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে দোষারোপ করতে রাজি না, তাদের কাছে এই বিষয়ে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান অনেক স্বস্তিদায়ক। যা সাম্প্রতিক জরিপে প্রতিফলিত হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মস্কোর বিরুদ্ধে আনা জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা গণতান্ত্রিক ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট 'কোয়াড'র সদস্য। এটি ওয়াশিংটনের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক দিনকে দিন সুদৃঢ় হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

চলতি মাসের শুরুতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেট ইঞ্জিন, বাণিজ্যিক মহাকাশ কর্মসূচি ও সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ চেইন বিষয়ে সহযোগিতা বাড়াতে রাজি হয়েছে। এসব কারণে ভারতকে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে পেতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আগ্রহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

চীনের বিকল্প ভারত

স্টকহোম সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের প্রধান জগন্নাথ পান্ডা গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ভারতকে বিদ্যমান বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প হিসেবে দেখছে।'

তার মতে, এখন ভারতকে দ্রুত এর অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন ও বিনিয়োগবান্ধব আইন তৈরি করতে হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর এমন চাওয়াকে 'বাস্তবসম্মত' বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

গত ৩১ জানুয়ারি দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, চীনের সরবরাহ চেইনের বিকল্প হিসেবে ভারতের দিকে ঝুঁকছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে, বাইডেন প্রশাসন চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সরবরাহ চেইন সরিয়ে নিতে ভারতের সহায়তা চাচ্ছে।

বাইডেন প্রশাসনের আশঙ্কা, সেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি নিয়মিত বৈঠক করছে।

হোয়াইট হাউস চাচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থেকে বেইজিংকে বিচ্ছিন্ন করে চীনা সেনাবাহিনীর উন্নয়নের গতি ধীর করে দিতে। 

বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গ টেনে বেইজিংকে একঘরে করার উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই দেশটির অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে এমনটিই আশা করছেন বিশ্লেষকরা।

গত ২৫ জানুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—'সমস্যা নেই, যদি চীন না থাকে তাহলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের দেখভাল ভারত করবে'। 

ভারতের প্রতি আসিয়ানের আস্থা

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের যোগাযোগ কয়েক হাজার বছরের পুরনো। সেই অঞ্চলের জাতিগুলোর ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে ভারতীয়দের প্রভাব সুগভীর।

আধুনিক ভারত রাষ্ট্রের পূর্বে বার্মা (মিয়ানমার) থেকে আরও পূর্বে ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্বে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া হয়ে ফিলিপাইন পর্যন্ত দিল্লির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এখনো বিদ্যমান।

সমালোচকদের অনেকে ভারতের দারিদ্র্য, দুর্বল পরিষেবা, অনুন্নত অবকাঠামো, রাজনৈতিক বিভেদ, সামাজিক বৈষম্য, প্রাদেশিক টানাপোড়েনসহ নানান বিষয়কে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এসবের গুরুত্ব কতটুকু তা প্রশ্নবিদ্ধ। 

কারণ, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তির পর ভারত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থানের ক্রমাগত উন্নতি করে চলেছে। 

বিশ্লেষক ক্লদিয়া চাইয়ের মতে, যেহেতু অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আসিয়ান দেশগুলো হস্তক্ষেপ করতে পছন্দ করে না, তাই ধর্মীয় ও জাতিগত উত্তেজনার মতো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের আগ্রহ কম। 

এমনকি, এসব কারণে আসিয়ান দেশগুলোর কাছে ভারতের সম্মান হয়তো কমাবে না বলেও মনে করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
The Costs Of Autonomy Loss of Central Bank

Bangladesh Bank’s lost autonomy has a hefty price

Economists blame rising bad debt, soaring prices and illicit fund flows on central bank’s waning independence

13h ago