‘পাংচারওয়ালা’ মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক: ওয়াক্‌ফ সম্পত্তিতে মোদির নজর কেন

ভারতে ওয়াকফ আইন সংশোধনের প্রতিবাদে হায়দারাবাদে বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: এএফপি

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা প্রায়শই শ্রমজীবী মুসলমানদের কটাক্ষ করতে 'পাংচারওয়ালা' শব্দটিকে একটি গালি হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। যারা সাইকেলের টায়ার-টিউব মেরামতের কাজ করেন তাদের পেশাকে হেয় করতে এই গালি। ভারতজুড়ে ওয়াক্‌ফ আইন সংশোধন নিয়ে মুসলমানদের প্রতিবাদের মধ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবার এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

গত সপ্তাহে ওয়াক্‌ফ বোর্ড নিয়ে কংগ্রেসের নীতির আপাত সমালোচনা করতে গিয়ে মোদি বলেন, 'যদি এটি (ওয়াক্‌ফ বোর্ডের সম্পত্তি) এর উদ্দেশ্য অনুযায়ী সঠিকভাবে ব্যবহার করা হতো, তাহলে আজ মুসলমান যুবকদের সাইকেলের পাংচার সারিয়ে জীবন কাটাতে হতো না।'

কংগ্রেসের নীতির কারণে ভারতে মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বোঝাতে চাইলেও সমালোচকদের মতে, নরেন্দ্র মোদি মূলত মুসলিমদের হেয় করার জন্যই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটা বলার কারণ হলো—মোদি ও তার দলের নেতারা হরহামেশাই ভারতের সংখ্যালঘুদের হেয় করতে এরকম কথা বলেন।

নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই তিনি সাম্প্রদায়িক বিভেদ গভীর করার জন্য মুসলিমবিদ্বেষী মন্তব্য করা শুরু করেন। তার সবচেয়ে আলোচিত বিদ্বেষমূলক মন্তব্যগুলোর মধ্যে আছে—মুসলিমদের 'অনুপ্রবেশকারী' বলা, তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ে উপহাস করা এবং 'বাচ্চা তৈরির কারখানা' বলা। ভারতে সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের 'পোশাক দেখে চেনা যায়' বলেও কয়েকবছর আগে মুসলমানদের কটাক্ষ করেছিলেন মোদি।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২০২৪ সালের এপ্রিলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব মঞ্চে নিজের যে ভাবমূর্তি তুলে ধরেন, আর সংখ্যালঘুদের নিয়ে যা মন্তব্য করেন—দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদন অনুসারে, মোদি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় দেওয়া তার ১৭৩টি ভাষণের মধ্যে অন্তত ১১০টিতে মুসলিমবিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন। বক্তব্যে তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে মুসলিম-তোষণের মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন এবং ভুল ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে হিন্দু ভোটারদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করার চেষ্টা করেছেন। শুনতে বিচিত্র মনে হলেও—ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা দেশে বিপদের মুখে আছে বলে প্রচার করেন মোদি।

ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি আইন নিয়ে কেন বিতর্ক

মুসলিম সম্পত্তি আইনে ওয়াক্‌ফ হলো দাতব্য ট্রাস্টের মতো। একজন ব্যক্তি তার সম্পত্তি দাতব্য বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ওয়াক্‌ফ করতে পারেন। একবার সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করলে, এর আর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে না। সেই সম্পত্তি যিনি দেখাশোনা করেন তাকে বলা হয় মোতাওয়াল্লি। যে উদ্দেশ্যে সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করা হয়েছে তা পরিবর্তন করা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ভারতেও এটি দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। এটিকে বিধিবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে ওয়াক্‌ফ বোর্ড এসব সম্পত্তি পরিচালনা করে।

ভারতে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৯ দশমিক ৪ লাখ একর যা বাংলাদেশের সিলেট বা টাঙ্গাইল জেলার আয়তনের চেয়েও বেশি। ভারতের রেলওয়ে এবং সামরিক বাহিনীর পর কোনো সংস্থার অধীনে থাকা এটাই সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি। মসজিদ, কবরস্থান, মাজারের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য এসব সম্পত্তি দান করা হয়েছে।

মোদি সরকারের ভাষ্য, ওয়াক্‌ফ বোর্ড বছরের পর বছর ধরে তাদের সম্পত্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করেনি। জমির আয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও জনকল্যাণে ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু এটা হচ্ছে না বলে ওয়াক্‌ফ আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জানার উদ্দেশ্যে গঠন করা সাচার কমিটির ২০০৬ সালের প্রতিবেদনও বলা হয়েছিল, ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে সেই সময়ে তাদের আয় ১২ হাজার কোটি টাকা হতো। ওয়াক্‌ফ বোর্ডে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কথা উঠে এসেছিল ওই প্রতিবেদনে।

সাচার কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, বেদখল এবং দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের কারণে প্রত্যাশিত আয় আসে না। এসব সম্পত্তি থেকে স্বল্প আয়কে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থিক ও সামাজিক পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করে সাচার কমিটি।

কিন্তু বিজেপি সরকার কি সত্যি-ই সৎ উদ্দেশ্য থেকে এই আইন সংশোধন করল নাকি বরাবরের মতো ভোটের মাঠে মেরুকরণ ঘটানোই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য? এই প্রশ্ন তুলেছেন লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধী দলের সদস্যরা।

বিজেপি সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু গত ২ এপ্রিল লোকসভায় বিলটি পেশ করেন।

ওয়াক্‌ফ আইনের সবচেয়ে বিতর্কিত ধারাগুলোর একটি হলো এখানে একজন অমুসলিমকে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিতর্কিত ধারা অনুযায়ী, রাজ্যগুলোর ওয়াক্‌ফ বোর্ডে নিজ নিজ রাজ্য সরকার অন্তত দুজন অমুসলিমকে নিয়োগ দিতে পারবে। একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিতর্কিত সম্পত্তিকে ওয়াক্‌ফ হিসেবে নির্ধারণ বা সরকারের মালিকানায় হস্তান্তর করার ক্ষমতা পাবেন।

পুরোনো আইন অনুযায়ী, কোনো সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ ঘোষণার একমাত্র অধিকারী ছিল ওয়াক্‌ফ বোর্ড। নতুন আইনে সেই অধিকার দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে। সেই সঙ্গে শত শত বছর ধরে যেসব জমি ওয়াক্‌ফ বোর্ডের অধীনে রয়েছে কিন্তু কোনো কাগজপত্র নেই—এসব জমি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন মুসলিম নেতারা।

বাবরি মসজিদ ভাঙার পর থেকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদের জায়গা নিয়ে যেভাবে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, দেশের সরকারপ্রধানসহ সংখ্যাগুরুদের অনেকের ভাষায়-আচরণে সংখ্যালঘু মুসলিমদের যেভাবে প্রান্তিক করে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তাতে সংশোধিত আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি নিয়েও যে ভবিষ্যতে একই ধরনের সমস্যা হবে না, সেটা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?

Comments

The Daily Star  | English
Election Commission has proposed stricter amendments to the election law

Fugitives can’t run in national elections

The Election Commission has proposed stricter amendments to the election law, including a provision barring fugitives from contesting national polls.

10h ago