এলভিস প্রিসলির বাড়ি নিলামে, প্রতারণা নাকি সত্য

কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক সংবাদমাধ্যমে বিস্ময়কর একটি খবর প্রকাশ পেল। নিলামে উঠতে যাচ্ছে বিখ্যাত পপ তারকা, প্রয়াত এলভিস প্রিসলির বিলাসবহুল বাড়ি 'গ্রেইসল্যান্ড'। নিমিষেই জল্পনা কল্পনা শুরু--এটা কি সত্য? না নতুন, অভিনব কোনো প্রতারনার জাল?
তথ্য প্রযুক্তি ও এআইর চরম উৎকর্ষের যুগে এসেও অনেক মানুষ ভুয়া প্রতিষ্ঠান, জাল সই, ভুয়া দলিল ও মিথ্যা মামলা উপস্থাপনের মতো 'প্রথাগত' প্রতারণার কৌশল ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
এমন পরিস্থিতিতে মাঝেমধ্যেই পত্রিকার শিরোনাম হয় প্রতারণার নানা অভিনব ঘটনা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতারক এলভিস প্রিসলির বাড়ির মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালান।
বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ানসহ একাধিক সংবাদমাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পপ সংগীতের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র এলভিস প্রিসলি ১৯৩৫ সালে মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের টুপেলো শহরে জন্ম নেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে সংগীতের জগতে ঝড় তোলেন তিনি। ১৯৫০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্ববাসী মেতে থাকে এলভিসের অনন্য রক এন রোল, পপ সংগীত ও বিশেষ নাচে।
তুমুল জনপ্রিয়তার মাঝে ১৯৫৭ সালে টেনেসি অঙ্গরাজ্যের মেমফিস শহরে গ্রেইসল্যান্ড নামের বাড়িটি কেনেন এলভিস। তবে এটা শুধু বাড়ি নয়—১৩ দশমিক ৮ একর জমির ওপর বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাসভবন।

১৯৭৭ সালে তার প্রয়াণের পর এটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। সেখানে প্রতি বছর ছয় লাখেরও বেশি পর্যটক আসেন। গ্রেইসল্যান্ডে এলভিসের জীবন ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। ভক্তদের জন্য তার ব্যবহৃত পোশাক, গ্রামোফোন রেকর্ড ও গাড়ি প্রদর্শন করা হয়।
অভিনব ফাঁদ
এই গ্রেইসল্যান্ড হাতিয়ে নেওয়ার এক অভিনব প্রতারণার ফাঁদ পাতেন লিসা জিনিন ফিন্ডলে নামে এক নারী।
মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কিম্বারলি সিটির বাসিন্দা ফিন্ডলের বিরুদ্ধে 'চিঠির মাধ্যমে প্রতারণার' অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কৌঁসুলি তার বিরুদ্ধে প্রতারণার উদ্দেশে ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি, আদালতের নথি নকল করা, ভুয়া ঋণের তথ্য দেওয়া ও এলভিসের প্রয়াত কন্যার সই জাল করার অভিযোগ আনেন।
এসবই তিনি করেন এলভিসের পরিবারের কাছ থেকে গ্রেইসল্যান্ডের মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে।

এলভিসের পরিবারকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার এই উদ্যোগকে মার্কিন বিচারক জন টি ফৌকস জুনিয়র 'বিস্ময়কর ফন্দি' ও 'অত্যন্ত জটিল চক্রান্ত' বলে আখ্যা দেন।
মেমফিসের আদালতে লিসা জিনিন ফিন্ডলেকে চার বছর নয় মাসের কারাদণ্ড দেন বিচারক। পাশাপাশি আরও তিন বছর নজরদারিতে থাকবেন তিনি। শুনানির সময় নিজের পক্ষে যুক্তি দিতে অস্বীকার করেন ফিন্ডলে (৫৪)।
যেভাবে প্রতারণার জাল বিছালেন ফিন্ডলে
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টানা ২০ বছর গ্রেইসল্যান্ডে বাস করেন এলভিস। বিটলম্যানিয়া ও ব্রিটিশ পপ-রকের জোয়ারে ক্যারিয়ারের সূর্য অস্ত যাওয়ায় এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষাদে শেষের বছরগুলোয় নিভৃতচারী জীবন যাপন করেন বিখ্যাত এই শিল্পী।
সব মিলিয়ে ওই এস্টেটের আয়তন ১২০ একর। আমেরিকান সংস্কৃতিতে এটি ঐতিহ্যবাহী মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এবং একে দেশটির জাতীয় ইতিহাসের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে নিয়মিত এলভিসের স্মরণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
২০২৩ সালে এলভিসের একমাত্র সন্তান লিসা মেরি প্রিসলির মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ওই সম্পত্তির মালিক হন তার মেয়ে অভিনেত্রী রাইলি কেঘ।

তবে ২০২৪ সালে নসানি ইনভেস্টমেন্টস নামে এক রহস্যজনক প্রতিষ্ঠান দাবি করে, মৃত্যুর আগে লিসা মেরি প্রিসলি গ্রেইসল্যান্ডকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করে তাদের কাছ থেকে ৩৮ লাখ ডলার ঋণ নিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি ওই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন, সেহেতু এখন প্রতিষ্ঠানটি গ্রেইসল্যান্ডের মালিকানা পাবে।
তদন্তের পর কৌঁসুলিরা জানান, আদতে ওই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বই নেই।
জটিল ও সূক্ষ্ম প্রতারণা
প্রতারক ফিন্ডলে বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে ওই ঋণ চুক্তির বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। অন্তত ঋণের চুক্তি-সংশ্লিষ্ট অন্তত তিন ব্যক্তি সেজে বক্তব্য দেন তিনি।
ভুয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে বসে, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে এলভিস পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হবে।
এটা না করলে গ্রেইসল্যান্ডের কার্যক্রম বন্ধ করে নিলামে তোলার হুমকি দেয় নসানি ইনভেস্টমেন্টস।

তার প্রতারণা-কৌশলকে আরও মজবুত ভিত্তি দিতে ফিন্ডলে ক্যালিফোর্নিয়ায় ভুয়া 'ঋণের অর্থ ফিরে পাওয়ার' আনুষ্ঠানিক দাবি জমা দেয়। এ সময় টেনেসিতে ভুয়া ঋণের জাল নথিও জমায় দেন ফিন্ডলে। এমনকি, 'ঋণ পরিশোধ না করায় গ্রেইসল্যান্ড নিলামে তোলা হচ্ছে'—এ কথা বলে স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেন তিনি।
গ্রেইসল্যান্ডের দেখভালের দায়িত্বে আছে এলভিস প্রিসলি এন্টারপ্রাইজেস নামের প্রতিষ্ঠান। তারা জানায়, এলভিসের পরিবারের কোনো সদস্য এ ধরনের ঋণ নেননি।
নিলাম ঠেকাতে আইনি ব্যবস্থা নেন লিসা মেরির মেয়ে রাইলি।
রাইলির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিলাম উদ্যোগ বন্ধ করেন এক বিচারক।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ পেলে ফিন্ডলে এলভিসের নাতনি রাইলির আইনজীবীদের কাছে দাবি করেন, এক নাইজেরীয় প্রতারক এই চক্রান্তের নেপথ্যে আছেন। তিনি এর জন্য দায়ী নন। তবে তার এই দাবি ধোপে টেকেনি।
২০২৪ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার হন ফিন্ডলে।

গত ফেব্রুয়ারিতে 'মেইল প্রতারণার' অভিযোগ মেনে নেন ফিন্ডলে। তিনি বিচারকদের জানান, তিনি তার কৃতকর্মের সব দায়দায়িত্ব মাথা পেতে গ্রহণ করেছেন।
গত মঙ্গলবার বিচারপতি ফৌকস ফিন্ডলেকে চার বছর নয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
ফিন্ডলের আইনজীবী দণ্ড কমিয়ে তিন বছর করার আবেদন করেন। তিনি যুক্তি দেন, এই প্রতারণায় এলভিসের পরিবারের আর্থিক ক্ষতি হয়নি এবং এটি খুব জটিল চক্রান্তও ছিল না।
তার যুক্তি খণ্ডন করে বিচারপতি ফৌকস বলেন, 'নিলামে এলভিসের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে এতে বড় আকারে 'ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ার বিকৃতি' ঘটত।
তিনি মন্তব্য করেন, 'এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল প্রতারণা ছিল।'
Comments