একঘরে হয়ে পড়ছে ইসরায়েল

গাজায় যুদ্ধ ও মানবিক সংকট অব্যাহত থাকায় বিশ্বমঞ্চে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ইসরায়েল। সিএনএন বলছে, শুধু কূটনৈতিক চাপ নয়, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রেও দেশটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে।
কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা
গাজায় স্থল অভিযান ও কাতারের মাটিতে হামাস নেতৃত্বের ওপর আঘাত হানার পর আন্তর্জাতিক মহল থেকে কঠোর নিন্দার ঝড় উঠেছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্তের প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে 'গণহত্যা' চালানোর অভিযোগ আনা হয়, অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরাও একই সুরে মত প্রকাশ করে। যদিও ইসরায়েলের সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন গাজা পরিস্থিতির কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কিছু অংশ স্থগিত করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া, কিছু পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলের নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারী এবং সহিংসতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো নরওয়ের বিশ্বসেরা 'সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের' ইসরায়েল থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার। পাশাপাশি ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র আমদানি নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।

সাংস্কৃতিক ও বিনোদন খাতে প্রভাব
ইসরায়েলের ওপর চাপ শুধু কূটনীতি ও অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, এটি সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতেও প্রবল আঘাত হেনেছে।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের টেলিভিশন চ্যানেল ২০২৬ সালের ইউরোভিশন সংগীত প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলের অংশগ্রহণ বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। আয়রল্যান্ডের জাতীয় সম্প্রচারমাধ্যম আরটিই স্পষ্ট করে বলেছে, গাজায় মৃত্যুর মিছিলে এমন একটি দেশের অংশগ্রহণ তাদের জন্য অনৈতিক হবে।
তবে ইসরায়েলি সম্প্রচারমাধ্যম কেএএন ১১ বলেছে, তারা ইসরায়েলের প্রতিনিধি নির্বাচনের কাজ চালিয়ে যাবে এবং সংগীতকে রাজনীতির হাত থেকে আলাদা রাখতে চায়। তবে ইউরোভিশনের আয়োজক ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন নভেম্বর মাসে সিদ্ধান্ত নেবে, যে কোন কোন দেশ অংশ নিতে পারবে।
বেলজিয়ামের গেন্ট মিউজিক ফেস্টিভালে ইসরায়েলি কনডাক্টর লাহাভ শানির সঙ্গে মিউনিখ ফিলহার্মোনিক কনসার্ট বাতিল করা হয়েছে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, তেল আবিবের গণহত্যামূলক কার্যক্রম সম্পর্কে শানির ব্যক্তিগত অবস্থান নিয়ে তারা স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছে না, যা তাদের জন্য সমস্যার কারণ।
হলিউড থেকেও ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। ওলিভিয়া কোলম্যান, এমা স্টোন ও অ্যান্ড্রু গারফিল্ডসহ বহু নামকরা অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
খেলাধুলায় একাকীত্ব
ক্রীড়া ক্ষেত্রেও ইসরায়েল মুক্ত নয়। সম্প্রতি স্পেনের দাবা প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের জাতীয় পতাকা ব্যবহার নিষেধ করা হয়, যার ফলে তারা প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসে।
ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উয়েফার কাছেও ইসরায়েলের নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে ইসরায়েলের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রী মিকি জোহর জানান, তারা বিষয়টি সমাধানে কাজ করছেন।
লিভারপুলের ফরোয়ার্ড মোহাম্মদ সালাহসহ বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত ফুটবলার গাজার মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বর্জনের পুনরাবৃত্তি?
বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের ওপর বিশ্বব্যাপী এই বর্জন ও বিচ্ছিন্নতাকে ১৯৫০-৯০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-বিরোধী বর্জন আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করছেন। দীর্ঘদিনের জাতিগত বৈষম্যের কারণে বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা এক বিশাল বর্জনের সম্মুখীন হয়েছিল, যা তাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিত্যক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল।
ইসরায়েলের সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকা দূত ইলান বারুচ বলছেন, 'সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টিই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে।'
তিনি মনে করেন, ইসরায়েলের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ বাণিজ্য সম্পর্ক এখন ঝুঁকির মধ্যে, কারণ এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মাঝে বিরাট বিরোধ তৈরি করছে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাম্প্রতিক ভোটে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর সংখ্যা বেড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কানাডা, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে অটল অবস্থানে থাকলেও অনেক ঐতিহ্যবাহী সমর্থক দেশ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইতোমধ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, যা তার আন্তর্জাতিক ভ্রমণে বাধা সৃষ্টি করছে। জাতিসংঘ সফরেও তাকে ফ্রান্স ও স্পেনের আকাশসীমা এড়িয়ে যেতে হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও মানবিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব অনেক ক্ষেত্রেই তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে, যা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-বিরোধী বর্জনের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
আগামী দিনগুলোতে এই একাকীত্ব কীভাবে গড়াবে, তা আন্তর্জাতিক কূটনীতি, যুদ্ধের সমাপ্তি এবং ইসরায়েলি সরকারের ভবিষ্যৎ নীতির ওপরই নির্ভর করবে।
Comments