ট্রাম্পের গাজা চুক্তি কি নেতানিয়াহুর ‘গলার কাঁটা’ হবে?

ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চেহারা 'দুই' রকম। এক রকম চেহারা তিনি দেখান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, অন্যরকম চেহারা দেখান নিজ দেশের বাসিন্দাদের কাছে। তার কথাও দুই ভিন্ন ভাষাভাষী দর্শকের কাছে ভিন্ন।

গত সোমবার বিশ্ববাসী নেতানিয়াহুর দুই রকম চেহারা দেখলো ও দুই রকম কথা শুনলো। এটি হয়ত অনেকের নজর এসেছে। সেদিন তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে ইংরেজিতে বললেন যে গাজা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবে তিনি রাজি।

কয়েক ঘণ্টা পর ভোল পাল্টিয়ে হিব্রুতে নিজ দেশের জনগণের উদ্দেশে বললেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে দেবেন না। শুধু তাই নয়, গাজার অধিকাংশ এলাকায় ইসরায়েলি সেনারা থাকবে।

নেতানিয়াহুর এই 'রাজনৈতিক ডিগবাজি' ভোটের মাঠে কতটা কাজে আসবে তা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তবে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি শেষমেশ নিজেই নিজের জালে ধরা পড়বেন? ট্রাম্পের গাজা চুক্তি কি নেতানিয়াহুর 'গলার কাঁটা' হয়ে উঠবে?

প্রবাদে আছে—অতি চালাকের গলায় দড়ি। স্বাধীন ফিলিস্তিন নিয়ে নেতানিয়াহুর টালবাহানা বা চালাকি বিশ্বনেতারা নিজ নিজ স্বার্থে মেনে নিলেও তাদের নিজ নিজ দেশের সাধারণ জনগণ তা মানছে না। দেশে দেশে উঠেছে ইসরায়েল বর্জনের ডাক। শুধু ডাকই নয়, তা কার্যকর হতেও শুরু করেছে।

বিশ্ববাসীর কাছে গাজা গণহত্যা লুকানোর সব চেষ্টাতেই ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সাধারণ মানুষও এখন দেশের বাইরে জনরোষের মুখে পড়ছে। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে—ইউরোপের বাজার ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি পণ্য মুক্ত।

শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, সেখানকার জনগণের অর্ধেকের বেশি এখন ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব পোষণ করছেন। আগামীতে ভোটের বাক্সে যদি এর প্রভাব পড়ে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের 'সুসম্পর্ক' ভিন্নরূপ নিতে পারে।

গতকাল সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক বিশ্লেষণের শিরোনাম করা হয়—'ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনায় ইসরায়েলের নেতানিয়াহু কতটা খুশি?'

এতে বলা হয়, ট্রাম্পের ২০-দফা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করা। তাই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একে স্বাগত জানিয়েছেন। এমনকি, ইসরায়েলি রাজনীতিকরাও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজি।

কিন্তু, গাজা যুদ্ধ বন্ধের যেকোনো উদ্যোগ বা ফিলিস্তিন নিয়ে যেকোনো শান্তি প্রক্রিয়া নানান অজুহাতে ভেস্তে দেওয়ায় পটু নেতানিয়াহু চিরদিন সবাইকে বোকা বানিয়ে রাখতে পারবেন না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

'ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল'

আল জাজিরার বিশ্লেষণে ট্রাম্পের গাজা যুদ্ধ বন্ধের কৌশলকে 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে— ইসরায়েলের সব দাবি মেনে নিয়ে ট্রাম্প যে পরিকল্পনা করেছেন বা ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহুকে বাড়তি সুবিধা দিতে ট্রাম্প যে কৌশল অবলম্বন করছেন তা নেতানিয়াহুর জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

গাজা চুক্তির মাধ্যমে যদি যুদ্ধ বন্ধ হয় তাহলে আগামী বছর নির্বাচনে যেতে বাধ্য নেতানিয়াহু। এই যুদ্ধের কথা বলে তিনি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেও এই যুদ্ধের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার সুযোগটা তার হাতছাড়া হয়ে যাবে।

একইভাবে নিজ দেশেই তার বিরুদ্ধে চলছে দুর্নীতির মামলা। যে যুদ্ধের অজুহাতে তিনি বারবার সেই মামলার তারিখ পিছিয়ে দিচ্ছেন সেই যুদ্ধই যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

শুধু তাই নয়, হামাস কিভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সদলবলে ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালালো এর তদন্ত শুরু হবে গাজা যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পরপরই। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুর দায় কতটুকু ছিল তাও আসবে আলোচনায়।

আশা করা যায়, এসবের সঙ্গে চাঙা হবে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, এখন যুদ্ধ বন্ধের যেকোনো প্রচেষ্টা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ আল জাজিরাকে বলেন, 'নেতানিয়াহু এখন বলবেন—দেখ আমি যুদ্ধ করেছি। পুরো গাজা ধ্বংস করে দিয়েছি। আমি এর বাইরেও যুদ্ধ করেছি যা আমার আগে কেউ কখনই কল্পনা করতে পারেনি। ইসরায়েল ও এর নিরাপত্তার প্রতি আমার ভালোবাসা প্রমাণ করেছি। এখন মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।'

'কিন্তু, এটা হচ্ছে নেতানিয়াহুর বয়ান। এটা বাস্তবতা নয়,' বলে মনে করেন গোল্ডবার্গ।

তাই, আপাতদৃষ্টিতে ট্রাম্পের পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর পক্ষে যেতে পারে বলে মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এটি তার রাজনৈতিক জীবনে তীব্র প্রভাব ফেলবে। ইসরায়েলের 'উদ্ধারকর্তা' হওয়া নিয়ে তার বয়ান একদিন গণরোষে হারিয়ে যাবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়—দিন শেষে এই গাজা চুক্তি নেতানিয়াহুর 'গলার কাটা' হয়ে উঠতে পারে।

Comments