কোন উদ্দেশ্যে আফ্রিকায় নজর ইসরায়েলের?

ইসরায়েল আফ্রিকা সম্পর্ক, ইসরায়েল জাম্বিয়া দূতাবাস, গাজা যুদ্ধ কূটনীতি, ইসরায়েল সাউথ সুদান, ইসরায়েল নাইজেরিয়া সম্পর্ক, ইসরায়েল সোমালিল্যান্ড পরিকল্পনা, আফ্রিকা ইসরায়েল কূটনৈতিক তৎপরতা, দক্ষিণ আফ্রিকা ফিলিস্তিন সমর্থন, আফ্রিকান ইউনিয়ন ইসরায়েল, ইসরায়েলি অস্ত
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স

গাজা যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন ইসরায়েল ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তখন তারা আফ্রিকা মহাদেশে তাদের পুরোনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে ও নতুন মিত্র খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি জাম্বিয়ায় ইসরায়েলি দূতাবাস পুনরায় চালু হওয়াকে ঘিরে আলোচনায় এসেছে আফ্রিকায় ইসরায়েলের কূটনৈতিক তৎপরতা। এর মধ্যে দিয়ে ৫২ বছর পর জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় ইসরায়েলের পতাকা উড়ল।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূতাবাস উদ্বোধন করে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডন সার বলেছেন, 'জাম্বিয়ায় ফিরছে ইসরায়েল, আফ্রিকায় ফিরছে ইসরায়েল'।

গাজায় ভয়াবহ সহিংসতার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েল যখন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তখন এই পদক্ষেপকে বড় অর্জন হিসেবেই দেখছে নেতানিয়াহু সরকার।

গিডনের দাবি, এখন আফ্রিকার অনেক দেশই ইসরায়েলের দূতাবাস খোলার জন্য লাইন দিয়ে আছে, তবে আমরা জাম্বিয়া দিয়েই শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকায় নতুন করে ইসরায়েলের সক্রিয় হওয়ার মূল লক্ষ্য সমর্থন আদায় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাব খর্ব করা। দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কড়া সমালোচক, এমনকি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাজায় গণহত্যার অভিযোগও তারাই এনেছে। ফলে জাম্বিয়া বা দক্ষিণ সুদানের মতো দেশকে পাশে টেনে ইসরায়েল একধরনের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' কৌশল প্রয়োগ করছে।

জাম্বিয়ায় দূতাবাস উদ্বোধনের এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজেরিয়া সফর করেছিলেন। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানো নাইজেরিয়া ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কোনো খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেনি। তবে এর দুই সপ্তাহ পর দেশটির সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট নাইজেরিয়ার ফিলিস্তিনি কমিউনিটির নেতা রামজি আবু ইব্রাহিমকে আটক করে। ইব্রাহিমের অপরাধ কী কিংবা ইসরায়েলি মন্ত্রীর সফরের সঙ্গে তার আটকের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

হাসকেল এরপরই যান ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র সাউথ সুদানে। দেশটির নাজুক পরিস্থিতিতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় ইসরায়েল। বর্তমানে সাউথ সুদানের প্রেসিডেন্ট সালভা কির ও ভাইস প্রেসিডেন্ট রিক মাচারের সমর্থকদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত চলছে। এক বিবৃতিতে গাজায় নৃশংস গণহত্যা চালানো ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'সাউথ সুদানের মতো গুরুতর মানবিক সংকটে থাকা দেশ বাদ দিয়ে সবাই কেন শুধু গাজার দিকেই তাকিয়ে আছে!'

তবে শ্যারেন যা বলছেন না তা হলো তার এই সফরের সময়েই ফাঁস হয় ইসরায়েল ও সাউথ সুদানের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনার খবর। যেখানে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক পূর্ব আফিকার এই দেশটিতে স্থানান্তরের বিতর্কিত পরিকল্পনার কথা উঠে আসে।

গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে রয়টার্স, এপির মতো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনের পরও বিতর্কিত এই পরিকল্পনা নিয়ে মুখ খোলেনি সাউথ সুদান।

একই আলোচনা আছে সোমালিল্যান্ড নিয়েও। যুক্তরাষ্ট্রে ও ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিনিময়ে গাজা থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসিত সোমালিল্যান্ডে বসতি স্থাপন করা হতে পারে। তবে সোমালিল্যান্ডের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত হতে চান না।

ইসরায়েল-আফ্রিকা সম্পর্ক

আফ্রিকার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের ইতিহাস জটিল। আফ্রিকায় ইসরায়েলের ভাবমূর্তি গড়পড়তা খারাপ হলেও এক্ষেত্রে ইসরায়েলি সরকারের প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। কয়েকটি দেশ তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ উদ্যোগে সাড়া দিলেও অধিকাংশ দেশ স্পষ্টতই দূরত্ব বজায় রেখেছে।

গবেষকদের মতে, আফ্রিকান দেশগুলো ইসরায়েলের থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হলো 'ফিলিস্তিন'।

সাউথ আফ্রিকা ইসরায়েলের কঠোর সমালোচক। তীব্র বর্ণবৈষম্যের শিকার দেশটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একই ধরনের দমননীতির বিরোধিতা করে আসছে। নেলসন ম্যান্ডেলার ১৯৯৭ সালে দেওয়া সেই বিখ্যাত উক্তি 'সাউথ আফ্রিকার স্বাধীনতা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া অসম্পূর্ণ' আজও দেশটির ফিলিস্তিন অবস্থানকে তুলে ধরে।

তবে আফ্রিকার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক সবসময়ই খারাপ ছিল না।

১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে যখন একের পর এক আফ্রিকান দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায়, তখন ইসরায়েল তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, তখন ডেভিড বেন গুরিয়ন ও গোল্ডা মেয়ারের মতো নেতারা ইসরায়েলকে জাতিসংঘে প্রভাব বাড়ানোর কৌশল হিসেবে 'স্বাধীন জনগণের বন্ধু' হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

তবে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তখন আফ্রিকান দেশগুলো ইসরায়েলকে শুধু ফিলিস্তিন নয়, মিশর তথা পুরো আফ্রিকার ওপরও আগ্রাসন চালানো একঘরে রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে শুরু করে। প্রথমেই উগান্ডা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। কয়েক মাসের মধ্যে আরও ২০টির বেশি আফ্রিকান দেশ সম্পর্ক ভেঙে দেয়। এই সম্মিলিত পদক্ষেপ ইসরায়েলের জন্য বড় কূটনৈতিক ধাক্কা ছিল। এর আগে কখনো কোনো অঞ্চল একসঙ্গে এত শক্তভাবে ইসরায়েলের বিপক্ষে যায়নি।

পরবর্তীতে ইসরায়েল কিছু দূতাবাস পুনরায় খুললেও সামগ্রিকভাবে আফ্রিকায় তার ভাবমূর্তি দুর্বলই থেকে গেছে।

ইসরায়েল যেসব দেশকে এখন আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তার মধ্যে নাইজেরিয়ার মতো কিছু দেশও রয়েছে, যারা ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য। বিশ্বজুড়ে ৫৭টি মুসলিম-প্রধান দেশ নিয়ে গঠিত এই সংস্থা বহুবার গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে।

সুদান এবং মরক্কোও ওআইসির সদস্য। তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পর, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সই হওয়া আব্রাহাম চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়।

২০২১ সালে দুটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ইসরায়েল আফ্রিকান ইউনিয়নে (এইউ) পর্যবেক্ষক মর্যাদা পায়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়া এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেন, তখনকার এইউ কমিশনের প্রধান মুসা ফাকি একতরফাভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অন্যদিকে, ফিলিস্তিন ২০১৩ সালে পর্যবেক্ষক মর্যাদা লাভ করে, যা তাকে দীর্ঘদিন ধরে এইউ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

ত্রাণসহায়তা থেকে অস্ত্র

ইসরায়েলের নজর বিশেষভাবে পূর্ব আফ্রিকার ওপর। বিশেষ করে ইথিওপিয়াতে, যেখানে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ইথিওপিয়ান ইহুদি বসবাস করে। ১৯৯১ সালে ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় তাদের মধ্যে কিছু লোককে গোপনে সেখান থেকে সরিয়ে নেয় ইসরায়েল। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পূর্ব আফ্রিকা সফরে যান এবং উগান্ডা, কেনিয়া, রুয়ান্ডা ও ইথিওপিয়া সফর করেন। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলের সাহায্য সংস্থা মাশাভ ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইথিওপিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, দক্ষিণ সুদান ও কেনিয়াতে সাড়ে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাঠিয়েছে। এসব সহায়তা মূলত কৃষি, পানি ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসরায়েলের সহায়তা বড় কোনো অর্থায়ন হিসেবে বিবেচিত হয় না। যেমন সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের অর্থায়ন পাওয়া ইথিওপিয়া ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩০ কোটি ডলার সাহায্য পায়। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা কমানোর পর বিশ্বব্যাংক, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন ইথিওপিয়ার প্রধান তহবিলদাতা হিসেবে উঠে এসেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল সাউথ সুদানই ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের পাশে থেকেছে। ২০১১ সালে সুদান থেকে আলাদা হওয়ার সময় ইসরায়েল সাউথ সুদানের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থন করেছিল। এই সমর্থনের ইতিহাস কয়েক দশকের পুরোনো। ১৯৬০ এর দশকে ইসরায়েলের মোসাদ প্রথমবার বিদ্রোহীদের সামরিক সহায়তা দেয়। সাউথ সুদানে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত হাইম কারেন ২০১৯ সালে তার এক লেখায় বলেন, ইসরায়েল বিচ্ছিন্নতা বাহিনীকে সমর্থন করেছিল সুদান ও সাধারণভাবে পুরো আরব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার জন্য। এর বহু আগে, ১৯৯৪ সাল থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ইসরায়েলি অস্ত্র সাউথ সুদানের বিদ্রোহীদের কাছে পাঠানো হচ্ছিল। এমনকি ২০১৬ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, সাউথ সুদান স্বাধীন হওয়ার পরপরই যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তাতে ইসরায়েলি অস্ত্রই ইন্ধন যোগাচ্ছিল।

তবে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য সাউথ সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি।

গত আগস্টে সাউথ সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছিল। সেই বিবৃতিতে তারা জানায় যে, ফিলিস্তিনিদের জোর করে সেই দেশে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা 'ভিত্তিহীন এবং সাউথ সুদানের সরকারি অবস্থান বা নীতির প্রতিফলন নয়।'

সাউথ সুদানের গণতন্ত্রপন্থি কর্মী মাহমুদ আকোত আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন, ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, ফিলিস্তিনিদেরকে এই দেশে সরিয়ে আনার কোনো চেষ্টা হলে তা তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়বে। সাউথ সুদানের নিজেদেরই অনেক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন থাকার পরও অন্যান্য আফ্রিকান দেশ এমনকি সাউথ আফ্রিকাও ইসরায়েলি অস্ত্রের আকর্ষণ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারেনি।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুসারে ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ক্যামরন, চাদ, গিনি, লেসেথো, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, সেশেলস, সাউথ আফ্রিকা ও উগান্ডা ইসরায়েল থেকে অস্ত্র কিনেছে।

এই দেশগুলোর অনেকেই এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। নজরদারি প্রযুক্তি, কৃষি সরঞ্জাম থেকে শুরু করে কনজিউমার পণ্য পর্যন্ত সবকিছুই ইসরায়েলের কাছ থেকে কিনছে।

সাউথ আফ্রিকা বিশ্লেষক রেনেভা ফুরি মনে করেন, ইসরায়েল আফ্রিকান নিরাপত্তা কাঠামোতে ঢুকে পড়ে অস্থিরতা থেকে যেমন সুবিধা নিচ্ছে, তেমনি এমন মিত্র তৈরি করছে যারা তাদের সামরিক দখলদারিত্ব ও নৃশংসতার সমালোচনা করবে না।

তিনি আল-জাজিরাকে আরও বলেন, 'এই অংশীদারিত্বগুলো ইসরায়েলকে একটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী মিত্র হিসেবে সাধারণীকরণ করে। একইসঙ্গে, এটি ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চালানো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ সরিয়ে দেয়।'

কূটনৈতিক খেলায় কি ইসরায়েল জিতছে?

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু করার পর আফ্রিকা মহাদেশে ইসরায়েলের যেটুকু সমর্থন ছিল, তাও প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এর একটি বড় প্রমাণ হলো—২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে।

এছাড়াও যুদ্ধের একেবারে প্রথম থেকেই আফ্রিকান ইউনিয়ন কোনো রাখঢাক না রেখে ইসরায়েলের নিন্দা করে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অধিকারকে সমর্থন করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়।

কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পতন বোঝাতে আরও কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। গত এপ্রিলে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবাতে আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তরে রুয়ান্ডার গণহত্যার ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান থেকে ইথিওপিয়ান বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আব্রাহত নিগুসেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নিগুসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে ক্ষোভ জানান।

জানা যায়, এই নির্দেশের পেছনে ছিলেন আফ্রিকার ইউনিয়ন কমিশন প্রধান জিবুতির মাহমুদ আলী ইউসুফ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ইউসুফ গাজায় যুদ্ধ বন্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এই ঘটনার পর সংবাদ সংস্থাকে একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নিগুসেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ আফ্রিকান ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক মর্যাদা হারিয়েছে ইসরায়েল।

গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আফ্রিকা মহাদেশের বেশিরভাগ দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান জানালেও, গবেষক ফুরি মনে করেন যে ইসরায়েল কিছুটা হলেও কূটনৈতিক খেলায় জিতছে। অন্তত জাম্বিয়ার মতো নতুন বন্ধুদের এবং মরক্কোর মতো আরব দেশগুলোর কাছ থেকে, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর এক মাস পর, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলের সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের প্রথম প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা ছয় আফ্রিকান দেশের মধ্যে জাম্বিয়া এবং সাউথ সুদানও ছিল। অন্য যে দেশগুলো ভোটদান থেকে বিরত ছিল, সেগুলো হলো—ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া, মালাউই ও গিনি। আফ্রিকার বাকি দেশগুলো এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

বিশ্লেষক ফুরি বলেছেন, জাম্বিয়ার মতো দেশগুলোর যে পরিস্থিতি সেটাকে কাজে লাগাচ্ছে ইসরায়েল। জাম্বিয়া ২০২০ সালে তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় এবং এখন তারা বিনিয়োগের জন্য মরিয়া। এই সুযোগে ইসরায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার এই অঞ্চলের ভেতরে আরও গভীরভাবে নিজেদের যুক্ত করার চেষ্টা করছে।

ইসরায়েল জাম্বিয়াতে বড় অঙ্কের কোনো ত্রাণ বা তহবিল দিয়েছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে গত আগস্টে ইসরায়েলি মানবিক সংস্থা "সেভ অ্যা চাইল্ড'স হার্ট" জাম্বিয়াকে একটি হার্ট-লাং মনিটরিং মেশিন দিয়েছে। এছাড়া জাম্বিয়ার কৃষি বিষয়ক ছাত্ররা নাকাব মরুভূমি অঞ্চলে স্পনসর্ড ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নেয়।

জাম্বিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ইসরায়েলের সরকারি প্রেস অফিস ও পররাষ্ট্র দপ্তরও তাদের বক্তব্য জানায়নি।

গবেষক ফুরি মনে করেন, আফ্রিকায় ইসরায়েলের প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্রে সাউথ আফ্রিকার একটি অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, এজন্য আফ্রিকান দেশগুলোর উচিত নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা এবং সাহায্যের নামে আসা বিদেশি প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করা। ফুরি আরও বলেন, আফ্রিকা মহাদেশ নিজেই কয়েক দশক ধরে সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছে, তাই ফিলিস্তিনের পাশে থাকাটা যে একটি নৈতিক দায়িত্ব, সেই বিষয়টি আফ্রিকান দেশগুলোর নিজেদের মনে রাখা উচিত।

তবে জোহানেসবার্গভিত্তিক সংহতি গোষ্ঠী 'আফ্রিকা ফর ফিলিস্তিন'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ দেসাই জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলের এই 'হতাশাজনক' কৌশল সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের কারণে ইতোমধ্যেই দুর্বল হতে শুরু করেছে।

দেসাই বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে মহাদেশজুড়ে সংহতি আন্দোলন দ্রুতগতিতে বেড়েছে।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা নিশ্চিত যে যেসব সরকার বা রাজনীতিবিদ বর্তমানে ইসরায়েলের প্রলোভনে আকৃষ্ট হচ্ছেন, জনগণই একদিন তাদের জবাবদিহি করবে। শেষ পর্যন্ত, আফ্রিকান মহাদেশে ইসরায়েলের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
charges against Sheikh Hasina at ICT

ICT case against Hasina: Verdict date could be set tomorrow

State-appointed defence counsel for the absconding accused concluded arguments today

1h ago