এক্সপ্লেইনার

যেভাবে কাজ করে টিকটকের অ্যালগরিদম

টিকটক। ছবি: মে গথিয়েঁ/আনস্প্ল্যাশড
টিকটক। ছবি: মে গথিয়েঁ/আনস্প্ল্যাশড

যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকের কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চীনের বাইটড্যান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে দরকষাকষি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, টিকটকের মাধ্যমে মার্কিনিদের ব্যক্তিগত তথ্য চীনের কাছে চলে যাচ্ছে।

এ বিষয়টি  টিকটকের মূল প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স বারবার অস্বীকার করলেও, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দেন, চীনের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়াতে পারবেন না।

যার ফলে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি যৌথ উদ্যোগে গঠিত প্রতিষ্ঠানের হাতে টিকটকের মার্কিন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে সম্মত হয়েছে বাইটড্যান্স। ওই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারের মধ্যে ওরাকল অন্যতম।

এই পরিস্থিতিতে নতুন করে টিকটকের অ্যালগরিদম ও রেকোমেন্ডেশন ইঞ্জিন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে টিকটকের জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারণ ওই প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম। এমনটাই মত দেন বিশেষজ্ঞরা।

কি আছে এই অ্যালগরিদমে? কি কি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে একজন ইউজারকে সুনির্দিষ্ট কনটেন্ট 'রেকমেন্ড' করে টিকটক? এসব প্রশ্নের উত্তর পাবেন আজকে এক্সপ্লেইনারে। 

কেন এই অ্যালগরিদম এত কার্যকর?

বিশ্লেষকদের মত, শুধু অ্যালগরিদম নয়। টিকটকের সাফল্যের পেছনে ছোট ভিডিও ফরম্যাটের দ্রুত বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তাও একটি বড় কারণ।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই টিকটকের ১৭ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে। ছবি: রয়টার্স

টিকটক দেখিয়েছে, একজন ইউজারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, আগ্রহের বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে অ্যালগরিদম তৈরি করলে সেটা বেশি কার্যকর হয়। অপরদিকে, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা একটি 'সোশাল গ্রাফ' তৈরি করে সেটার ভিত্তিতে অ্যালগরিদম তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে, ইউজারের নিজের পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে বেশিরভাগ মানুষের আগ্রহ বা 'গড়পড়তা আগ্রহ' বেশি গুরুত্ব পায়।

মোটা দাগে বলতে গেলে, ফেসবুক ধরে নেয় 'যেহেতু বাংলাদেশের অনেক মানুষ যেহেতু এ বিষয়টিতে আগ্রহী, আপনিও এতে আগ্রহী হতে পারেন'। তারপর প্ল্যাটফর্মটি সেই গড়পড়তা আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে নানা কনটেন্ট আপনাকে দেখায়।

অপরদিকে, টিকটক আগে ইউজারের আগ্রহ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নেয়। তারপর সে অনুযায়ী কনটেন্ট দেখায়।

ছোট ভিডিও ফরম্যাটে সীমাবদ্ধ থাকায় টিকটকের অ্যালগরিদম খুব দ্রুত ইউজারের পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে। এটি এতোটাই গতিশীল, যে ইউজার দিনের কোন সময় কোন ধরনের কনটেন্ট দেখতে পছন্দ করে, সে তথ্যও সে আমলে নিতে পারে এবং সে অনুযায়ী কনটেন্ট দেখাতে পারে।

ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে যা অকল্পনীয় বললেও কম বলা হয়।

পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠার সময় থেকে টিকটক মোবাইল প্ল্যাটফর্মে সীমাবদ্ধ থাকায় এর নির্মাতাদের পিসি/ল্যাপটপ নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতে হয়নি।

অন্যান্য অ্যাপগুলো একই ইউজারের জন্য পিসি ও মোবাইল সংস্করণের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে যেয়ে হিমশিম খায়। এই ঝামেলা থেকে টিকটক পুরোপুরি মুক্ত। পিসি-ল্যাপটপের অপেক্ষাকৃত জটিল ইন্টারফেস নিয়েও বাইটড্যান্সকে মাথা ঘামাতে হয়না।

শর্ট ভিডিও ফরম্যাটের একদম প্রাথমিক যুগ থেকে এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে টিকটকের নাম। মোটরসাইকেলকে যেমন অনেকে হোন্ডা ডাকেন, তেমনি এক সময় (ফেসবুকের রিলস, ইউটিউবের শর্টস আসার আগে) ছোট ভিডিও আর টিকটক মোটামুটি সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এখন পরিস্থিতি সেরকম না হলেও শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মের মধ্যে টিকটকই সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়।

টিকটক জনপ্রিয়তা পাওয়ার বেশ কয়েক বছর পর প্রতিপক্ষরা বাজারে আসে।

ইউটিউবের শর্টস ২০২১ সালে আর ইনস্টাগ্রামের রিলস ২০২০ সালে চালু হয়।

উভয় প্রতিষ্ঠানই ডেটা ও সেবা উন্নয়ন অভিজ্ঞতায় টিকটকের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে।

অ্যালগরিদম নিয়ে গবেষণায় যা জানা গেছে

টিকটক প্রায়ই ইউজারের আগ্রহের বিষয়ের বাইরে অনেক কিছু  'রেকমেন্ড' করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপকরা বারবার বলেছেন, এটা টিকটকের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য জরুরি।

টিকটক লোগো ও কিবোর্ড। প্রতিকী ছবি: রয়টার্স
টিকটক লোগো ও কিবোর্ড। প্রতিকী ছবি: রয়টার্স

গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির গবেষকদের এক সমীক্ষা প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয়েছে, টিকটকের অ্যালগরিদম ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ রেকোমেনডেশন ভিডিওর ক্ষেত্রে ইউজারের আগ্রহের জায়গাগুলোকে আমলে নেয়। এ বিষয়টি জানতে ৩৪৭ টিকটক ইজার ও পাঁচটি অটোমেটেড বটের সহায়তা নেন গবেষকরা। 

'টিকটক অ্যান্ড দ্য আর্ট অব পার্সোনালাইজেশন' নামের সমীক্ষায় গবেষকরা বলেন, 'এই গবেষণা এটাই প্রমাণ করেছে যে টিকটক অ্যালগরিদম ইউজারদের আগ্রহের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার পরও এমন অনেক ভিডিও তাদেরকে দেখার জন্য রেকমেন্ড করে, যেগুলো ওইসব বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়। এভাবে টিকটক ওই ইউজারের সব ধরনের আগ্রহের বিষয় সম্পর্কে আরও নির্ভুল তথ্য জোগাড় করে। পাশাপাশি ইউজারদের সামনে প্রতিনিয়ত অভিনব ও নতুন কনটেন্ট উপস্থাপনের ফলে তারাও দীর্ঘ মেয়াদে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী থাকেন।'

Comments