শিশুর স্পিচ ডিলে বুঝবেন যেভাবে, চিকিৎসায় কি ভালো হয়?

শিশুর দেরিতে কথা বলা যেকোনো বাবা-মা ও অভিভাবকের জন্যই দুঃশ্চিন্তার। শিশু দেরিতে কথা বলছে কেন, সেই সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতিও বিদ্যমান।
এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা আহমেদ।
শিশুদের দেরিতে কথা বলা বা স্পিচ ডিলের কারণ
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, শিশুদের দেরিতে কথা বলা বা স্পিচ ডিলে বিভিন্ন কারণে হতে পারে। একটি শিশুর কথা বলার জন্য সঠিকভাবে কানে শোনা, মস্তিষ্ক দিয়ে বোঝা এবং মুখ দিয়ে সঠিকভাবে উচ্চারণ করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যতিক্রম হলেই শিশুদের কথা বলায় ব্যাঘাত ঘটে অথবা কথা বলা বিলম্বিত হতে পারে।
শারীরিক কারণ
১. শারীরিক কারণ, যেমন শিশুটি যদি কানে কম শোনে অথবা শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়।
২. শিশুর যদি বিকাশজনিত সমস্যা থাকে, যেমন: সেরিব্রাল পালসি, অটিজম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, যাকে কগনিটিভ ডিলে বলে।
৩. সিন্ড্রোমিক চাইল্ড, যেমন: ডাউন সিনড্রোম। এখানেও শিশুর স্পিচ ডিলে হতে পারে।
৪. ডেভেলপমেন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডিজঅর্ডারের কারণেও শিশুর স্পিচ ডিলে হতে পারে।
৫. টাং টাই যেখানে শিশুর জিহ্বা নাড়তে সমস্যা থাকে, যেমন: জিহ্বাটি নিচের দিকে জোড়া লাগানো থাকে, জিহ্বা নাড়তে সমস্যা হয়, কথা বলতে সমস্যা হয়—এটাতেও স্পিচ ডিলে হতে পারে।
৬. এছাড়া মুখ ও গহ্বরের মাংসপেশিতে যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, তাহলে শিশুটির কথা বলা ও কথা উচ্চারণ করতে সমস্যা থাকতে পারে। এর কারণেও স্পিচ ডিলে হতে পারে।
পরিবেশগত কারণ
১. অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস অতিরিক্ত ব্যবহার করা।
২. একক পরিবার বা বাবা-মা কর্মজীবী হওয়ার কারণে শিশুদের কথা বলার সঙ্গীর অভাব এবং সামাজিক মেলামেশায় সুযোগ কম পাওয়া শিশুর দেরিতে কথা বলার একটি অন্যতম কারণ।
৩. বহুভাষার সংস্পর্শে আসা স্পিচ ডিলের একটি কারণ। শিশুটি মোবাইল ফোন, ট্যাব বা টেলিভিশনে ভিন্ন ভাষার কার্টুন বা ভিন্ন ভাষায় অনুষ্ঠান দেখছে। কিন্তু বাসায় তার বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যরা হয়তো বাংলা ভাষায় কথা বলছে। সেক্ষেত্রেও দুই ভাষার দ্বন্দ্বে অনেক সময় শিশুদের কথা বলা দেরি হয়ে যায়।
শিশুদের দেরিতে কথা বলার সমস্যা বাড়ছে কেন?
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, শিশুদের দেরিতে কথা বলার সমস্যা বর্তমানে বেড়েই চলেছে। এর প্রকৃত কারণ বলা মুশকিল। এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। তবে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে স্ক্রিনে অনেক বেশি টাইম দেওয়া শিশুদের স্পিচ ডিলের একটি অন্যতম কারণ, যা আধুনিক প্রযুক্তির একটি বিরূপ প্রভাব। শিশুরা কথা শুরুর আগেই তার হাতে মোবাইল ফোন, ট্যাব ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং টেলিভিশনে বিভিন্ন ভাষার কার্টুন এবং বিভিন্ন প্রোগ্রাম দেখায় তাকে আগ্রহী করা হয়। যার কারণে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং মনোযোগের ব্যাপ্তি বয়স অনুযায়ী বাড়ে না। অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার সুযোগ কম হয়। আগে শুধুমাত্র প্রবাসী শিশুদের ক্ষেত্রে বহুভাষিক সংস্পর্শের কারণে স্পিচ ডিলে হতো। কিন্তু বর্তমানে দেশে থেকেও দেখা যায় শিশুরা বহু ভাষার সংস্পর্শে আসছে। কারণ ভাষা শেখার আগেই শিশু বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে আসে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে। যার ফলে মাতৃভাষা শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয় এবং এর প্রয়োগও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কী করে বুঝবেন একটি শিশু দেরিতে কথা বলছে
১. এক বছর বয়সে কোনো শিশু একটি থেকে দুইটি অর্থবহ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, যেমন: বাবাকে বাবা, মাকে মা বলা।
২. শিশু ১৮ মাস বয়সে ১০ থেকে ২০ অর্থবহ শব্দ বলতে পারে।
৩. দুই বছর বয়সে দুইটি শব্দ জোড়া লাগিয়ে বাক্য বলতে পারবে, যেমন: এটা কী, এটা দাও ইত্যাদি।
৪. তিন বছর বয়সে তিনটি শব্দ জোড়া লাগিয়ে কথা বলা বা শেখানো ছড়া বলতে পারবে।
৫. চার বছর বয়সে শিশু সব ধরনের জটিল বাক্য তৈরি করতে পারবে এবং তার মনের ভাব আদান-প্রদান করতে পারবে।
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, এর ব্যত্যয় হলেই বুঝতে হবে শিশুর স্পিচ ডিলে আছে।
করণীয়
১. শিশুকে বেশি বেশি সময় দেওয়া, গল্প করা, শিশুর সঙ্গে কাল্পনিক খেলাগুলো খেলা এবং সময়মতো কথা শিখছে কি না, তা অবশ্যই ভালোভাবে খেয়াল করা।
২. তিন বছর বয়সের আগে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন বা ট্যাব না দেওয়া।
৩. মাতৃভাষা শেখার আগেই শিশুকে অন্য ভাষার কার্টুন বা অনুষ্ঠান দেখতে না দেওয়া।
৪. শিশুর কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা আছে কি না, যেমন: কানে শুনছে কি না, নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিচ্ছে কি না, বাবা-মায়ের সঙ্গে চোখে চোখ রাখছে কি না, হাসির উত্তরে হাসছে কি না—এই বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে।
৫. শিশু তার চাহিদা বোঝাতে পারে কি না বা আঙ্গুল দিয়ে কিছু দেখাতে পারে কি না, অন্য শিশুদের দেখলে খুশি হয় কি না, নাকি সে একা একা থাকতে চায়—এগুলো খেয়াল করা জরুরি।
কোনো সমস্যা মনে হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন শিশু বিশেষজ্ঞ অথবা একজন শিশু নিউরোলজি বিশেষজ্ঞকে দেখানো প্রয়োজন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
স্পিচ ডিলের কারণ নির্ণয়ে শিশুটির পরিপূর্ণ ইতিহাস বিশেষ করে তার জন্মের সময় কোনো সমস্যা ছিল কি না, মানসিক বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে কি না এবং তার পারিবারিক ইতিহাস যেমন: পরিবারে এই ধরনের সমস্যা কারো আছে কি না এসব ইতিহাস নিয়ে এবং শিশুটিকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সমস্যা সম্পর্কে ধারণা নিয়েই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। হেয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট বা কানে শোনার পরীক্ষা, সাইকোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট বা বুদ্ধি পরীক্ষা এবং যদি শিশুটিকে অটিজম মনে হয়, তাহলে কিছু পরীক্ষা আছে, যেমন: chat revised (M CHAT-R), di es em 5 (DSM-5), ADCL, ADOS ইত্যাদি পরীক্ষা তাকে করানো হয়।
চিকিৎসা
ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, শিশু দেরিতে কথা বলার চিকিৎসা নির্ভর করে কী কারণে শিশুটির স্পিচ ডিলে হয়েছে, তার ওপর। যদি পরিবেশগত কারণে শিশুর স্পিচ ডিলে হয়ে থাকে, তাহলে সেই কারণগুলো নির্ণয় করা এবং কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন: শিশুকে বেশি সময় দেওয়া, তার সঙ্গে খেলাধুলা করা, গল্প করা, মোবাইল ফোন, ট্যাব ব্যবহার করা কমিয়ে দেওয়া এবং টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখলেও বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠান না দিয়ে তার মাতৃভাষা শেখার আগে নিজের মাতৃভাষায়, যেমন: বাংলা ভাষার অনুষ্ঠানগুলো দেখানো জরুরি। বাবা-মা শিশুর সঙ্গে তার মাতৃভাষায় কথা বলা জরুরি। আর শিশু যদি অনেক পিছিয়ে পড়ে, তাহলে অবশ্যই স্পিচ থেরাপি দিতে হবে।
শিশুর কানে শোনায় সমস্যা থাকলে তাকে স্পিচ থেরাপি দিয়ে কোনো উন্নতি পাওয়া যায় না। প্রথমে তার কানে শোনার জন্য চিকিৎসা করা খুব জরুরি, এজন্য একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে, সেখানে তারা হেয়ারিং এইড অথবা ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টশনের মাধ্যমেই শিশুটিকে চিকিৎসা করেন।
শিশুর যদি সেরিব্রাল পালসি অথবা যেকোনো কারণে বুদ্ধিতে বয়সের তুলনায় পিছিয়ে থাকে, তাহলে দেরিতে হলেও স্পিচ থেরাপি দিলে উন্নতি হয়।
যদি শিশুর অটিজম থাকে, তাহলে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি আর্লি ইন্টারভেনশন থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পেশাল স্কুলিং ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
যদি শিশুর টাং টাই বা জিহ্বা জোড়া লাগানো থাকে, তাহলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জোড়াটা ছাড়িয়ে দিলেই এবং পরে স্পিচ থেরাপি দিলেই শিশু কথা বলতে পারে।
ডেভেলপমেন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডিজঅর্ডার একটি সমস্যা, যেখানে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বয়স অনুযায়ী সবদিকেই ঠিক থাকে। কিন্তু সে কথা বলায় বয়সের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। এটি সাধারণত পরিবারে অন্য শিশুদেরও থাকতে পারে। এই ডেভেলপমেন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ ডিজঅর্ডারের শিশুদের স্পিচ থেরাপি দিলে উন্নতি হয়।
এটা কি ভালো হয়?
এটি মূলত নির্ভর করে কী কারণে শিশুটির কথা বলা দেরি হচ্ছে তার ওপর। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই সমস্যা যত তাড়াতাড়ি খেয়াল করা যায় এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া যায় এবং যত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায় ততই উন্নতি হয়। তবে এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
Comments