মেজবানের সরব যাত্রা—চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা

মেজবান রান্না। ছবি: সংগৃহীত

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নয়, আপ্যায়ন ও আতিথেয়তার সংস্কৃতির জন্যও সমৃদ্ধ। 

মেজবান (স্থানীয়ভাবে মেজ্জান) সেই সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, স্থানীয়দের আন্তরিকতা ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। 

প্রচলিত ধারণা ও বিভিন্ন উৎস বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই উৎসব গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে, বহু সময় ধরে রূপান্তর ও প্রসার লাভ করেছে।

মেজবান কী?

মেজবানের গরুর মাংস। ছবি: সংগৃহীত

ফার্সি ভাষা থেকে আগত 'মেজবান' শব্দের অর্থ অতিথি আপ্যায়নকারী বা নিমন্ত্রণকারী।  সাধারণভাবে মেজবান বলতে বোঝানো হয় বিশাল ভোজ, যেখানে অনেক মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়।

আঞ্চলিকভাবে চট্টগ্রামে বলা হয় 'মেজ্জান'। পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলায় 'জেয়াফত' নামে একটা ভোজরীতি আছে, যার সঙ্গে মেজবানের অনেকটাই মিল রয়েছে।

উৎপত্তি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য

উপমহাদেশে ফার্সি ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাবে চট্টগ্রামে আতিথেয়তার এই রীতি গড়ে ওঠে। সুনির্দিষ্ট সময় না পাওয়া গেলেও কিছু পুরোনো সাহিত্য ও পুঁথিতে 'মেজোয়ানি' বা 'মেজবানি' শব্দের উল্লেখ আছে।

একসময় এ আয়োজনে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে অতিথিরা বসতেন। খাবার পরিবেশন হতো মাটির পাত্রে বা সানকিতে। নিমন্ত্রণের খবর ছড়ানো হতো পাড়া-মহল্লায় মুখে মুখে বা ঢাকঢোল পিটিয়ে খবর দিয়ে।

খাবারের উপাদান ও মেনু

মেজবানের কেন্দ্রবিন্দু হলো গরুর মাংস। 'মেজবানি গোশত' বিশেষভাবে রান্না করা হয় প্রচুর মরিচ ও মসলার সংমিশ্রণে, যেন ঝাল মুখরোচক স্বাদ হয়।

গরুর হাড় দিয়ে বানানো ঝোলকে বলা হয় নলার ঝোল বা নলাকাজি, যা অতিথিরা বিশেষভাবে পছন্দ করেন।

ডাল: বুট বা চানার ডাল সবচেয়ে জনপ্রিয়। কখনও মাসকলাই ডালও দেওয়া হয়।

কালা ভুনা: মসলার মাত্রা বাড়িয়ে, ঘন ও কালচে করে মাংস রান্না।

ভাত ছাড়া মেজবান অপূর্ণ, সাধারণত সাদা ভাতের সঙ্গেই পরিবেশন হয় এসব পদ।

গরুর মাংসের কালাভুনা। ছবি: সংগৃহীত

রান্নার ধারা ও বাবুর্চির দক্ষতা

বিশাল ডেকচিতে একসঙ্গে শত কেজি মাংস রান্না হয়। রান্নার জন্য লাকড়ির চুলা বা বিশেষ চুলা ব্যবহার করা হয়।

বাবুর্চিদের আলাদা দল থাকে, যাদের অনেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে 'মেজবান' রান্না করে আসছেন। তাদের হাতে স্বাদে থাকে বিশেষ জাদু।

'মেজবান' রান্নার মসলার মিশ্রণ, মাংস কাটা, ঝোল ঘন করা—সব কিছুতে সময় ও অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট থাকে।

সামাজিক ও ধর্মীয় মেলবন্ধন

'মেজবান' আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে—মৃত্যুবার্ষিকী, কুলখানি, মিলাদ, আকিকা, বিবাহ, নতুন বাড়ি বা ব্যবসা শুরু ইত্যাদিতে।

এখানে সামাজিক বৈষম্যের দেয়াল থাকে না। ধনী-গরিব, চেনা-অচেনা—সবাই দাওয়াতে আসে এবং একই কাতারে বসে খায়।

আনন্দ ও প্রতিযোগিতা

অনেক সময় ধনী পরিবার প্রতিযোগিতার মতো আয়োজন করে—গরুর সংখ্যা বেশি, অতিথির সংখ্যা বেশি—এর মাধ্যমে আতিথেয়তার মর্যাদা প্রদর্শিত হয়।

মেজবান শুধু খাওয়াদাওয়ার ভোজ নয়, এটি গ্রামীণ-শহুরে উৎসবের রূপ নেয়। গান, আড্ডা, মিলনমেলা—সব মিলিয়ে এটি পূর্ণাঙ্গ এক সামাজিক অনুষ্ঠান। 

বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্নতা

চট্টগ্রামের ভেতরে ও আশপাশের অঞ্চলে মেজবানের ধরনে কিছু ভিন্নতা দেখা যায়।

চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের গ্রাম: গরুর মাংস প্রধান উপাদান, রান্না ঝাল-মশলাদার। শহরে কমিউনিটি হল, প্যান্ডেল বা টেবিল-চেয়ারে আয়োজন করা হয়। উন্নত মানের মাংস ও মসলা ব্যবহৃত হয়। অভিজ্ঞ বাবুর্চিরা রান্না করেন, যারা পুরোনো স্বাদ ধরে রাখেন।

উপকূলীয় এলাকা (সীতাকুণ্ড, বাঁশখালী ইত্যাদি): গরুর মাংসের পাশাপাশি মাছও ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে চিংড়ি, রূপচাঁদা বা অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ। স্থানীয় উপকরণ সহজে পাওয়া যায়। রান্নায় ঝালের মাত্রা অঞ্চলভেদে কমবেশি হয়।

পাহাড়ি ও পার্বত্য এলাকা: গরুর পাশাপাশি ছাগল বা স্থানীয় প্রাণীর মাংসও ব্যবহৃত হয়। রান্নার ধরন কিছুটা আলাদা—আগুন জ্বালানো, হাঁড়ি ব্যবহার, মসলা প্রয়োগ ভিন্ন। স্থানীয় উপাদানই বেশি ব্যবহৃত হয়। স্বাদ সাধারণত হালকা হয়। খোলা পরিবেশে আয়োজন বেশি দেখা যায়।

নোয়াখালী ও পার্শ্ববর্তী জেলা: এখানে মেজবানকে 'জেয়াফত' বলা হয়। খাবারের ধরন প্রায় একই হলেও মাছ ও ডালের ব্যবহার তুলনামূলক বেশি। স্বাদে ঝাল কম থাকে, আবার ডালের বৈচিত্র্য বেশি দেখা যায়। গোশতের পরিমাণ অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।

বর্তমান চিত্র

আগে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে সবাই খেতেন, এখন শহরে কমিউনিটি হল, টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার বেড়েছে। খরচ অনেক বেড়ে গেছে। গরু, মসলা, শ্রম—সবকিছুই ব্যয়বহুল হয়েছে।

খাবারে বৈচিত্র্য এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায় বা অন্য ধর্মাবলম্বীরা মাংসের বদলে মাছ ও সবজি দিয়ে আয়োজন করেন।

অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট এখন 'মেজবান প্যাকেজ' চালু করেছে। তবে অনেকে মনে করেন, আসল 'মেজবান' মানে হলো বাড়ির দাওয়াত, যেখানে আন্তরিক আতিথেয়তা থাকে—শুধু ব্যবসায়িক খাবার নয়। 

ঢাকায় মেজবান

ঢাকায় বসবাসকারী চট্টগ্রামের বাসিন্দারা রাজধানীতেও নিয়ে এসেছেন মেজবানের ঐতিহ্য। ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতি প্রতিবছর 'মেজবান' আয়োজন করে, যেখানে হাজারো মানুষ জড়ো হন।

বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও কমিউনিটি হলে এখন মেজবান আয়োজন করা হয়। যেমন: 'মেজ্জান হইলে আইয়ুন', 'স্বাদে চাটগাঁ', 'মেজবান বাড়ি'—এসব রেস্টুরেন্টে নিয়মিতভাবে মেজবানি খাবার পরিবেশন করা হয়।

ঢাকায় আয়োজন সাধারণত আরও অভিজাত ধাঁচে হয়। নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো, সুন্দর সাজসজ্জা, নির্দিষ্ট মেনু এবং আধুনিক পরিবেশে মেজবানের আসর বসে।

চট্টগ্রামবাসী মনে করে, এসব আয়োজন তাদের শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ 

খরচ বেড়ে যাওয়া: গরুর মাংস, মসলা, পরিবহন—সব কিছুর দাম বাড়ছে।

আসল স্বাদ রক্ষা: অনেক জায়গায় 'মেজবান' নামে খাবার বিক্রি হয়, কিন্তু আসল কালো ভুনা বা নলার ঝোল পাওয়া যায় না।

সামাজিক পরিবর্তন: শহরে সময় ও জায়গার অভাবে ছোট পরিসরে মেজবান হচ্ছে বেশি।

সংস্কৃতি সংরক্ষণ: প্রবাসে চট্টগ্রামের মানুষেরা মেজবান প্রথা টিকিয়ে রাখছেন, তবে আধুনিক প্রভাবের কারণে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

2h ago