ফিরে দেখা ক্যাম্পাসের দিনগুলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মল চত্বর, ঢাবি ক্যাম্পাস, ঢাবি স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, ক্যাম্পাস স্মৃতিকথা, মল চত্বর পরিবর্তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতি, জারুল কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ফুল, বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি, ক্যাম্পাস জীবনের গল্প, ঢাকা বিশ্ববিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সাজ্জাদ ঈবনে সাইদ/স্টার

প্রবাসে থাকতে বারবার মনে পড়তো পরিবার, ধানমন্ডির রাস্তা, শঙ্কর-লালমাটিয়ার অলিগলি, আর পাঁচ বছর কাটিয়ে দেওয়া ক্যাম্পাসের কথা। আজিমপুর, নিউমার্কেটের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই নানান স্মৃতি। স্কুলের ১০ বছর, এই দীর্ঘ সময়ে হাজার খানেক দিন, আর হাজারেরও বেশি ঘটনাপ্রবাহ, আর তার সঙ্গে জড়িত আবেগ। আজিমপুরের পাশ দিয়েই নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলো হয়ে কলাভবনের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গৌরব এখন অনেকাংশেই নেই, নিজেও বুঝতে পারি, সর্বনাশ হয়ে গেছে আমাদের!

কিন্তু তারপরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার ইচ্ছা, চেষ্টা এবং ভর্তি হওয়ার পর সুকান্তের কবিতার মতনই ১৮'র সেই টগবগে দিনগুলো, বন্ধুমহল, সাংস্কৃতিক নানান অঙ্গন, এসব আসলে প্রতিস্থাপন করার মতো না। আর এই ক্যাম্পাসে যেই বিষয়টি জড়িত ছিল, তা হলো এখানকার বৃক্ষশোভিত পথ, নানান গোত্রের মহীরুহ, দেশি উজ্জ্বল রঙের নানা ফুল, যাদের নাম জানতে পেরেছি এখানে পাঠ্যবই পড়বার পাশাপাশি। ইট-কাঠের শহরে বুঝতে শিখলাম, প্রকৃতি আসলে আমাকে কেবল আনন্দ নয়, দুদণ্ড শান্তিও দেয়। এই আলোয় ঝলকানো রেস্তোরাঁ, মাশরুমের মতো গজিয়ে ওঠা দালানকোঠা আর কত!

গ্রীষ্মেই যখন জারুল, কৃষ্ণচূড়া নিয়ে রঙ্গিন ছবি, নানান জনের স্মৃতিকথা সামনে আসছে, তখন মনে পড়লো ঢাবির মল চত্বর, যা এখন আর আগের মতোন বৃক্ষশোভিত নেই। এই মল চত্বরেই আমার প্রথম পরিচয় জারুল আর সোনালুর সঙ্গে। সারি সারি উঁচু গাছগুলো রোদে যেমন ছায়া দিয়েছে, তেমনি বৃষ্টিতে ক্ষণিকের আশ্রয়। পালাক্রমে ঋতু বদলেছে, জারুল আর সোনালু গাছের ফুলেরাও ঝরে গেছে। কিন্তু সব সময়েই ক্যাম্পাসে নেমে এই পথ ধরে হাঁটতাম। হাঁটতাম কারণ ভালো লাগা আর শান্তি কাজ করত। কেননা এ জায়গাটুকুতে কোনো দালান কিংবা অফিস ছিল না, ছিল শুধু সারি সারি গাছ। রেইনট্রিগুলোর নিচ দিয়ে হেঁটে গেলে টুপ করে পানি পড়তো। গ্রীষ্মে যেমন উজ্জ্বল লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ে লাল গালিচার মতোন হয়ে থাকত, আবার বর্ষায় জারুল ফুলে হালকা বেগুনী। শীতের সন্ধ্যায় আবার সোডিয়াম বাতি আর কুয়াশার মিশ্রণে মনে হতো, কোথায় এসে পরলাম! শহুরে নানা জটিলতায় এই কুয়াশা আর গাছেদের সারির মাঝে কিছুটা 'এসক্যাপিসম' করা যায়!

গ্রীষ্মের অলস আর ক্লাস শেষে ক্লান্ত দুপুরগুলোয় এই চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকতো ঢাবির লাল বাসগুলো। কী করবো পড়াশোনা শেষে, ভালো নম্বর আসবে তো কিংবা বাসা থেকে ফোনে বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিতাম, 'উফ, আসছি তো!'। কিন্তু কখনো ভাবিনি দিনগুলো শেষের পথে। এখন তো পুরো মল চত্বরটাই নেই। ক্যাম্পাস ছেড়েও চাকরিজীবনে ঢোকার পর যতবারই গিয়েছি ঢাবিতে, প্রতিবারই এই মল চত্বরে হেঁটেছি। এই চত্বর উন্নয়ন আর শোভাবর্ধনের কাজে কতগুলো গাছ কেটে উপড়ে ফেলা হলো, জুড়ে দেওয়া হলো আধুনিকায়নের কীসব। ক্যাম্পাসের একটা শান্তশিষ্ট জায়গা, এখন দেখলে মনে হয় কোনো পার্ক। দুদণ্ড বসে চিন্তা করা, প্রকৃতিকে চেনা, ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে নানান পুষ্প-বিহঙ্গের পরিচয় হওয়ার সুযোগটাই কমিয়ে দেওয়া হলো।

যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম তখন, যখন এই চত্বর নষ্ট করে দেওয়া হলো। ক্যাম্পাসের অনেককেই এই নিয়ে পোস্ট শেয়ার করতে দেখছিলাম, ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কেননা ক্ষুদ্র আমি, এ নিয়ে বলব কোথায়! অনেক বড় বড় ব্যক্তির কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞায়ন ভিন্ন কি না! দু'বছর পর দেশে ফিরে 'নতুন' আর 'আধুনিক' মল চত্বরে যখন গেলাম, বিরক্তি ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি আসেনি। যতবারই এখন যাওয়া হয়, এই বিরক্তির কোনো পরিবর্তন হয় না। 
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা যারা প্রায় বছর দশেক আগে পাস করে বেরিয়ে এসেছি, তারা আসলে বেশ কিছু চত্বর, বইমেলার ভিন্ন পরিবেশ, কম দালানকোঠা পেয়েছি, যা এখন আর শিক্ষার্থীরা পায় বলে মনে হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তো আর শুধু পাঠ্যবই পড়ে তাই লিখে দিয়ে পাস করা নয়। এখানে যদি প্রকৃতির সঙ্গে চেনাজানা না হয়, সংস্কৃতি, ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় না হয়, তাহলে চিন্তাশীল মানুষ গড়ে উঠবে কোথায়!

একটি অট্টালিকায় আধুনিক প্রযুক্তি, ঝাঁ চকচকে মেঝে, বোর্ড দিয়ে দিলাম, এ তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচায়ক হয় না! তাই এই শহুরে দালানকোঠায় হারিয়ে যাওয়া মল চত্বরের স্মৃতিগুলো থাকুক সেই সব জারুল, কৃষ্ণ-রাধাচূড়া আর সোনালুর মতোনই উজ্জ্বল। কেননা আমাদের বর্তমান প্রতিকূল পরিবেশে দরকার রয়েছে এসব উজ্জ্বল স্মৃতির।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body being taken to Manik Mia Avenue for janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

2h ago