সংগ্রাম ও স্বাদের ঐতিহ্যে মোল্লা হোটেলের ৫৭ বছরের যাত্রা

মোল্লা হোটেলের সাইনবোর্ড (উপরে), বিখ্যাত গরু ভুনা ও মালিক মো. মাহামুদ্দুল্লা ওরফে হিরো মোল্লা। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল যাওয়ার পথে হামদহ বাসস্ট্যান্ডে রেজাউল ফিলিং স্টেশনের কাছেই অবস্থিত সেখানকার বিখ্যাত 'মোল্লা হোটেল'। ঝিনাইদহের মানুষ এক নামেই চেনেন এই হোটেলটিকে।

৫৭ বছরের পুরোনো এই হোটেলটির খাবারের জন্য যেমন রয়েছে সুখ্যাতি, তেমনি রয়েছে উত্থান-পতনের ইতিহাস।

১৯৬৮ সালের কথা, মৃধা রওশন আলী মোল্লা ছোট পরিসরে হোটেলটি চালু করেন। তার ছেলে মো. মাহামুদ্দুল্লা মোল্লা বর্তমানে হোটেলটি চালান। তার ডাকনাম হিরো। স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি হিরো মোল্লা নামেই পরিচিত।

তিনি বলেন, 'হোটেলটি চালু করেছিলেন আমার আব্বা। সেটা পাকিস্তান পিরিয়ডের কথা৷ ১৯৬৮ সালে। আমি তখন অনেক ছোট। তখন হোটেল ছিল শহরের ভেতরেই৷ শহরের যেখানে পায়রা চত্বর, তার বিপরীতে ছিল অগ্রণী ব্যাংকের শাখা৷ এখন ওটা আর নেই। সেই ব্যাংকের শাখার নিচে মানে বিল্ডিংয়ের নিচতলায় আমার আব্বা মৃধা রওশন আলী মোল্লা ছোট পরিসরে হোটেল চালু করেন। তখন থেকেই ভাত, মাংস, মাছ, সবজি, ডাল—সবই পাওয়া যেত। ব্যাংকের চাকরিজীবীরা খেতেন। আশপাশের দোকানের লোকজন খেতেন। এভাবে শুরু।'

চমৎকার রান্নার কারণে স্বল্প সময়ের ভেতরেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় 'মোল্লা হোটেল'। তবে এর ভেতরই আসে প্রচণ্ড এক ঝড়, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।

সেসময় ঝিনাইদহে ব্যাপক হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, লুটপাট হয়। তখন হোটেলটি যে ভবনে ছিল, সেটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

এমন ধ্বংসযজ্ঞের পর দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে রওশন আলী মোল্লা আবার শূন্য থেকেই শুরু করেন হোটেল। তখন স্থান পরিবর্তন করে 'মোল্লা হোটেল' চলে আসে আরেকটু সামনে।

মাহামুদ্দুল্লা মোল্লা জানান, 'অগ্রণী ব্যাংক থেকে একটু সামনে বিপরীত দিকে ছিল মুন্সী মার্কেট। সেখানে আব্বা পরে হোটেলটা চালু করেন। অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেছে। আবার সব নতুন করে শুরু করা। তখন প্রথমদিকে আমরা পান-সিগারেটও বিক্রি করেছি। সাথে অল্প করে ভাত- তরকারি। তারপর ধীরে ধীরে লাভ বাড়তে থাকল, হোটেল আবার বড় হলো। এভাবে একসময় মোল্লা হোটেল আবার তার পুরোনো নাম-ডাক ফিরে পেল।'

তবে সেই সাফল্যের পর আবার প্রতিকূলতা। ১৯৮৪ সালে মার্কেট ভেঙে গড়ে তোলা হয় আধুনিক মার্কেট। নতুন মালিকরা সেখানে ভাতের হোটেল রাখতে চাইলেন না। তারপর মোল্লা হোটেলকে চলে আসতে হয় শহর থেকে একটু দূরে হামদহে।

কিন্তু খ্যাতি কমল না একটুও, 'মোল্লা হোটেলের' গরু ভুনা বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল। সেটার জনপ্রিয়তা আজও তেমনই অটুট আছে। এর বাইরে তাদের খাসি ভুনাকে বলা যায় আরেকটি আন্ডাররেটেড রেসিপি। এটিও তাদের দারুণ রান্নার জন্য পরিচিত, অনেকের প্রিয়।

এর বাইরে মাছ, ডিম, ভর্তা সবই মেলে এখানে। ভাতের পাশাপাশি করা হয় গমের রুটিও।

হিরো মোল্লা বলেন, 'এখানে হোটেল আনার পর ব্যবসা ভালোই চলছিল। এরপর ১৯৮৭ সালে আব্বা মারা গেলেন। তারপর আমাকেই ব্যবসার হাল ধরতে হলো। সেই থেকে ৩৮ বছর হয়ে গেলো, এখনো হোটেলটা চালাচ্ছি।'

তবে ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন মাহামুদুল্লাহ। তিনি বলেন, 'ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে এখন এমন না। জিনিসপত্রের দাম বেশি। কিন্তু মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা মূল্য খুব বেশি বাড়াইনি। দিন ভালো গেলে দেখা যায় গরুর মাংস ২০-২৫ কেজি যায়। আবার যেদিন ব্যবসা ভালো হয় না, সেদিন দেখা যায় ১০ কেজি যায়।'

হোটেলের এক কর্মচারী জানালেন, 'মোল্লা হোটেল ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। এটি কখনোই বন্ধ হয় না।'

তার কথা সমর্থন করে হিরো মোল্লা বললেন, 'এখানে দুই শিফটে ভাগ হয়ে লোক কাজ করে। সবারই ছুটি নেওয়ার সুযোগ আছে। সেভাবে ম্যানেজ করে লোক রাখি, কাজ করাই।'

স্থানীয় রিকশাচালক আলামিন এই হোটেলের মাংস রান্নার বেশ প্রশংসা করলেন। তিনি বললেন, 'আপনি যখন খাবেন, সেটা খেয়ে তো তৃপ্তিটা আসতে হবে। এদের রান্নায় একটা ব্যাপারটা আছে। খাওয়ার পর একটা ভালো লাগা কাজ করে। বিশেষ করে গরুর মাংস রান্নাটা খুব ভালো।'

স্থানীয় বাসিন্দাসহ বাইরে থেকে নানান কাজে ঝিনাইদহে যারা আসেন, অনেকেই এখানে খাবার খান। তাদের আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে পেরেছেন বলে মনে করেন মাহামুদ্দুল্লা মোল্লা। স্থানীয় নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এখানে নিয়মিতই খেতে আসেন বলে জানান তিনি। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন অফিসে, আয়োজনে ও অনুষ্ঠানে  নিয়মিতই অর্ডারের ভিত্তিতে খাবার সরবরাহ করেন তারা৷

হিরো মোল্লা বলেন, 'আমার আব্বা যে মান ধরে রেখে হোটেলটা চালিয়েছিলেন, আমি সবসময়ই চেষ্টা করছি সেটা ধরে রাখতে। মোল্লা হোটেলের খাবার মানুষ পছন্দ করে, সেটা দেখলে সবসময়ই ভালো লাগে। আমাদের হোটেলের বয়স তো অনেকদিন হলো, তবে আমরা স্বাদে ও মানে একইরকমই থাকার চেষ্টা করে আসছি সবসময়।'

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body being taken to Manik Mia Avenue for janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

2h ago

Farewell

10h ago