গান সমাজকে যেভাবে বিকশিত করে

'জন্মের সময় আমরা জন্তু হয়ে জন্মাই। কিন্তু সংস্কৃতিই আমাদের মানুষে পরিণত করে।' কথাটি বলেছেন গবেষক গোলাম মুরশিদ। আমরা আসলে যে যেভাবেই জন্মাই না কেন সংস্কৃতি আমাদের শুদ্ধ মানুষ হিসেবে পরিচিত করে বা নির্মাণ ঘটায়। আর সংস্কৃতির বাহন হিসেবে গানের ভূমিকা অনন্য। এর মূলে রয়েছে গান কবিতার স্থান। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদও ছিল একটি গানের সংকলন। এরপর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে গীতগোবিন্দ প্রায় সব সাহিত্যে গানের বেষ্টনীতে আবদ্ধ ছিল। তাই হয়তো পদকর্তাগণ খুব সচেতনভাবে পদাবলীগুলোর উপরে রাগ ও তালের নির্দেশও করেছেন।

সংস্কৃতি ও গান একে অন্যের পরিপূরক। সংস্কৃতির নানা বিষয়কে ভিত্তি করেই রচিত হয় গান। যেমন মৈমনসিংহ-গীতিকার পালাগুলোতে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষাসহ তাদের জীবন, ধর্ম, প্রণয়, নারীর  স্বাধীনচেতা রূপ,পতিভক্তি, সামাজিক নানা আচার ইত্যাদি সবকিছুই ধারণ করে রেখেছে। সংস্কৃতি বিবর্তন সহজে ধারন হয় গানে।  

বর্তমানে হাজারো জটিলতায় প্রত্যেকে নিজেদের শৈশবের স্মৃতি কুড়াতে থাকে। আঁতুর ঘর হতে মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অবধি এ সংস্কৃতি প্রসারিত। নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ঘরোয়া আনুষ্ঠানিকতা যেমন: শিশুর কানে আযান দেওয়া, পেয়াজের কালি বা হাড়ের উপর কালি তুলে শিশুকে নজর ফোঁটা দেওয়া, একটু বড় হলে মুখে ভাত দেওয়া, মুসলিম হলে সুন্নতে খতনা, গায়ে হলুদ, বিবাহ থেকে মৃত্যুর পর কুলখানি ইত্যাদি রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখতে পাওয়া যায় । 

পাশাপাশি গর্ভবতী নারীর সাত বা নয় মাসে আনুষ্ঠানিকতা পালন, শিশু ভূমিষ্ঠ হলে নাভিচ্ছেদের পূর্বে গৃহকর্তার কাছে উপঢৌকন দাবি, শিশুর নামকরণ, শিশুর মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, মুসলিম সমাজে ঘটকালি, বরযাত্রীর আগমনে বরপক্ষকে সংবর্ধনা, বিয়ের পর জামাইকে হাত ধুয়ে দেওয়া, বাসরঘর সাজানো, শ্বশুরবাড়িতে কন্যাকে বরণ, বিয়ের পর বৌ ভাত অনুষ্ঠান,পণপ্রথা, কৌলীন্য প্রথা, বিয়ের পর স্বামীবিয়োগ হলে নাক ফুল খুলে ফেলা এবং রঙহীন বস্ত্র পরিধান করা, ইত্যাদি সবই আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ৷

মজার বিষয় হলো প্রত্যেকটি পর্বে গানের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। শিশু কোলে নিয়ে মা ঘুম পাড়ানি গান করেন, বিয়েতে পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাগণ হাতে কুলা নিয়ে মেহেদী পাতা তোলেন আর নানা বিয়ের গীত করেন সাথে অঙ্গ দুলিয়ে ধামাইল নৃত্য করেন, পানি দিয়ে একে অন্যেকে ভিজিয়ে পানি খেলা করে- এগুলো শিশুমনে নির্মল উচ্ছ্বাস ও সবাই একেসাথে মিলেমিশে থাকার শিক্ষা দেয়। আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে যৌথভাবে কাজ করার শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠে প্রজন্ম। 

একটা সময় পাড়া মহল্লায় জারি, সারি, মুর্শিদি, বাউল, আর যাত্রা গানের আসর বসতো। সারাদিন গ্রামগঞ্জের সকল মানুষ কাজ কর্ম সেরে রাতে একসাথে যাত্রা গান দেখতে যেত। শীতকালে গানের অনুষ্ঠান বেশি হত। শীতকালীন পিঠাসহ হরেক রকম খাবারের দোকানও বসত৷ এসময় বাড়ি ফিরে আসার সময় প্যাকেট ভরে জিলাপি নিয়ে আসত।

লোক গানের আসর, ছবি: ডয়চে ভেলে

পহেলা বৈশাখে বৈশাখী মেলার আয়োজনের সাথে গানের অনুষ্ঠান থাকতো। বর্তমানে "এসো হে বৈশাখ এসো এসো" গানটি ছাড়া কেমন যেন অপূর্ণতা কাজ করে। বৈশাখী মেলার পাশাপাশি গ্রামে গঞ্জে নানারকম লোকক্রীড়ার আয়োজন থাকতো যেমন : ঘোড়া দৌড়, লাঠিখেলা, নৌকা বাইচ, সাপুড়ে নৃত্য ইত্যাদি। এগুলো সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যেতো। এতে মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ও চর্চা হত।

 

একসময় গানকে সকল প্রাকৃতিক সংকটের সমাধান মনে করা হত। যেমন অনাবৃষ্টি হলে বা খরা হলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গেয়ে চাল, ডাল তুলে রান্না করে একসাথে কিশোর - কিশোরীরা নেচে গেয়ে উদযাপন করতো আর একসাথে গেয়ে উঠতো-

আল্লাহ মেঘ দে ছায়া দে পানি দে রে তুই, আল্লাহ মেঘ দে। উত্তরবঙ্গে রাজবংশীদের মধ্যে বৃষ্টির দেবতাকে উদ্দেশ্য করে নারীদের নাচ-গানের প্রচলনও আছে। যা 'হুদমার গান' নামে পরিচিত। বন্যা হলে বা অতিবৃষ্টি হলে গ্রামের মানুষ দলবেঁধে মাছ ধরার মহা উৎসবে মেতে উঠতো। যাওয়ার সময় একসঙ্গে গেয়ে উঠতো- "হেইয়োরে হেইয়ো/ সামাল সামাল সামাল ওরে সামনে তরী বাইয়ো"।

আবার যখন নদী মাঠ ঘাটের পানি শুকিয়ে আসতো তখন মাছ ধরার ধুম পড়তো। এ উৎসবকে বলা হতো পলো বাওয়া উৎসব। বৃষ্টির কারণে যখন সাপের উৎপাত বেড়ে যেতো তখন মানুষ সাপের ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবী মনসার পূজা উপলক্ষে যে উৎসব পালন করতো তার নাম ঝাঁপান। সাপের ঝাঁপি নিয়ে বেদেরা ঘন্টার পর ঘণ্টা সাপের খেলা প্রদর্শন করে এবং গেয়ে ওঠে মনসা ও চাঁদ সওদাগর কাহিনী ভিত্তিক ঝাঁপান গান-

শুন শুন গুণীজন আশ্চর্য কাহিনী
লোহার বাসরে কীরূপে প্রবশিল ফণী?

একসময় যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা। নদী, নৌকা ও  মাঝি নিয়ে রচিত হয়েছে হাজার হাজার " ভাটিয়ালি গান। মাঝির ক্লান্ত অবসরে গানই প্রাণের সঞ্চার যোগাতো। ভাটির টানে মাঝি হাল ছেড়ে দিয়ে মনে আনন্দে টান দিতো...মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে/ আমি আর বাইতে পারলাম না।'  

মাঝ নদীতে মাঝির মনে নানা আত্ম-জিজ্ঞাসা চলে। কোথা হতে এলাম? কেনো এলাম আবার কোথায় চলে যাবো। কথাগুলো তার জীবজগত অতিক্রম করে ভাব নদীতেও অন্তিম তুফান তুলে। 

যাতায়াতের মাধ্যম নৌকাকে কেন্দ্র করে এদেশে 'নায়র' সংস্কৃতিও বিদ্যমান ছিল। গায়ের নববধূ তার বাপের বাড়ির লোকজন আসার অপেক্ষায় নৌকার পানে চেয়ে চেয়ে মাসের পর মাস বছরের পর বছর অতিক্রম করতো। এখানে নায়র মানে স্বল্প দিনের অতিথি। সে তারা বাপের বাড়ি নৌকাযোগে যে বেড়াতে যেতো তাকে নায়র বলা হতো। কিন্তু এমনও হতো বিয়ের পর আর কেউ তাকে নিতে আসতো না। সে কেবল পন্থের পানে চেয়ে থাকতো।  মিরা বর্মণের লেখা শচীন দেব বর্মণের গানটি আজো মনে দাগ কাটে--

কে যাসরে ভাটির গান গাইয়া/ আমার ভাইধন রে কইয়ো/ নাইওর নিতো বইলা। মানুষের পৃথিবীতে আগমন ও প্রত্যাগমণকেও অনেক লোকসাধকগণ  নাইয়রের ' সাথে তুলনা করেছেন। 

এ দেশ পীর মুর্শিদের দেশ। তাই এ সংস্কৃতির এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পীর -মুর্শিদে বিশ্বাস। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা চলচ্চিত্র কিংবা মানুষের হৃদয় উভয়স্থলে আজো জীয়ন্ত রয়েছে তাজাফুল সমৃদ্ধ পীরের দরগাহ শরীফ তথা মাজার সংস্কৃতি। এখানে ভক্ত বা আশেকানগণ পীরের টানে মিলিত হন। তারা পীরের দরবারে নানা সংকট তুলে ধরেন এবং পরিত্রাণের উপায় খোঁজেন। তারা পীরকে ভালোবেসে  পীরের শানে নানা গানও রচনা করেন। মাইজভাণ্ডারী গান তার এক অনন্য উদাহরণ -

ভাণ্ডারী রহিম রহমান/ কে বুঝিতে পারে তোমার কুদরতেরি শান। 

অন্যদিকে মুর্শিদকে ভর করে তারা পারলৌকিক মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেন। তাইতো রচনা হয়েছে হাজারো মুর্শিদী ও মারফতি গান। বাউল শাহ আব্দুল করিমের 

তন্ত্র মন্ত্র পড়ি যত তার ভেতরে তুমি নাই
শাস্ত্র গ্রন্থ পড়ি যত আরও দূরে যাই
কোন সাইরে খেলতেছো লাই 
ভাবতেছি তাই অন্তরে 
মুর্শিদ ধন হে কেমনে চিনিব তোমারে।

গানটিতে মারফতের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টি মিলনের তীব্র ব্যকুলতা উভয় প্রতিফলিত হয়েছে। 

বহুবিবাহ এ সংস্কৃতির রন্ধে রন্ধে। এদেশে ইসলাম প্রচারের প্রাক্কাল থেকে আজ পর্যন্ত এ সংস্কৃতি বহমান। শুধু বিবাহের মূল কারণ কী তাতে পরিবর্তন এসেছে। বহুবিবাহের সাথে সংসারে শাশুড়ী ও ননদের জ্বালাতনও অনন্য মর্যাদা পেয়ে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে। আর এ বিষয়গুলো ঠাঁই পেয়েছে বাংলার গানগুলোতে-  সতীনের জ্বালায় জ্বলি পতী হইছে পর/ এ দুনিয়ায় কেউ নাই আমার দুষ্কের দুষ্কর। (ভাটিয়ালি গান)

আবার
গেরামের মাতব্বর আসে যায় দিনভর
কথা কয় মশকরা করি..য়া
ননদীর জ্বালাতন শ্বাশুড়ির শাসন
আমি না আর সইতে পারি।। (পল্লীগীতি) 

তাছাড়া সামাজিক নানারকম অসংগতি নিয়ে রচিত ও গীত হয় " গম্ভীরা গান, রাত জেগে গায় " জাগ গান/ অষ্টক গান, সকলে একসঙ্গে বারবার পুন:রাবৃত্তি করে " ধুয়া গান, চৈত্র বৈশাখে খরা দেখা দিলে " নৈলার গান, শরিয়ত- তরীকত ভিত্তিক নানা তর্ক বিতর্কের বিচার গান, ফকিরি গান, প্রেম ও বিনোদন ভিত্তিক " ঘাটু গান,ঝুমুর গান, নারীর হৃদয়ের বারমাসের বিলাপে রচিত " বারমাসি গান,কর্ম ও শ্রম নির্ভর জমি চাষের গান, ক্ষেত নিড়ানির গান,ধান ভানার গান, ধান কাটার গান,ছাদ পিটানোর গান, নৌকা বাইচের গান, পটে অংকিত কাহিনির ভিত্তিক পটুয়া গান,পালকির গান, পুতুল নাচের গান ইত্যাদি। 

এ সকল গান মানুষের মনে কল্পনার জগত তৈরি করে। যেমন একসময় মানুষ রেডিও গান শুনতো আর এর কাহিনী কল্পনা করে নিতো। এখন প্রযুক্তির নানা উৎকর্ষে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ভিন্ন ভিন্ন রুচি সমৃদ্ধ গান প্রচার হচ্ছে যা মানুষ হৃদয়ে প্রতিনিয়ত নানামুখী চেতনার যোগান দিচ্ছে। বর্তমানে শহরে জীবন ও সংস্কৃতিতে শিশুরা ঘরে বন্দি দশায় বড় হচ্ছে। যা তাদের মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলছে। তারা অনেকেই ধৈর্যহীন ও আক্রমণাত্মক হয়ে বেড়ে উঠছে। এক্ষেত্রে সুন্দর ও সুস্থ সংস্কৃতির গান হতে পারে অন্যতম নিয়ামক। 

সম্প্রতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তি আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, সব মানুষই গান শোনে, সুন্দর সমাজ গড়তে হলে গান শোনার প্রয়োজন, গান মানুষকে সুন্দর করে। একমাত্র তারাই গান শোনে না, যারা মানুষ হত্যা করে। একটি  সুন্দর গান মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্কের এক বিশেষ নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনেকটা কমে যায়। অপরদিকে মানুষের হৃৎপিণ্ড হলো একটি অনৈচ্ছিক পেশী। যা ছন্দময় সুর ও তালে হৃদয়কে দোলিত হয়। তাই গান মনুষ্য হৃদয়ের স্থবিরতা ও চঞ্চলতা উভয় অবস্থার জন্য দায়ী বটে। সুতরাং এ কথা বাঞ্ছনীয় যে একটি সুন্দর গান মানুষের মনের অবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমেই সুন্দর জীবন সম্ভব।

শেষ করব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথায়- সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বহুমুখিতা চাইব, বহুমাত্রা চাইব, তার বিকাশ নানা পথে হবে, তার উৎকর্ষ নানা দিকে বিকশিত হবে, এটা চাইব। কিন্তু আমরা একই সঙ্গে ঐক্যও চাইব। সে ঐক্য দেশের মধ্যে এবং সে ঐক্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গেও।

Comments

The Daily Star  | English

Sabalenka beats Anisimova to win second straight US Open title

The Belarusian has not missed a hardcourt major final since 2022 and her latest trophy brings her Grand Slam haul to four, as she became the first woman to win back-to-back US Opens since Serena Williams claimed three straight from 2012 to 2014

3h ago