‘অসময়ের’ বইমেলা, কী ভাবছেন লেখক ও প্রকাশক

মাসব্যাপী একুশে বইমেলা নিয়ে অনেক আকাঙ্ক্ষা লেখক পাঠক ও প্রকাশকদের। বইয়ের বৃহত্তম এই উৎসবকে ঘিরে সবার মাঝেই থাকে আলাদা আগ্রহ ও উদ্দীপনা। কিন্তু আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পবিত্র রমজানের কারণে অমর একুশে বইমেলা ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলা একাডেমি।
এ সিদ্ধান্তের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন লেখক ও প্রকাশকরা। একই বছর দুটি মেলা ও ভাষার মাসের মেলা বিজয়ের মাসে আনার সিদ্ধান্তকে অবিবেচক বলেও অভিহিত করেছেন অনেকে।
এ ছাড়া বইমেলার স্থায়ী ও কার্যকর কোনো নীতি প্রণয়ন না করে এবং সৃজনশীল ও বৈষম্যবিরোধী প্রকাশকদের মতামত না নিয়ে দেড় মাস এগিয়ে তারিখ নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষোভ ও শঙ্কা বিরাজ করছে। একই বছর দুটি বইমেলা হলে ক্ষতি ও ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে কী ভাবছেন লেখক ও প্রকাশক মেলা নিয়ে—তা জানতে কয়েকজন লেখক ও প্রকাশকের কাছে প্রশ্ন রেখেছিল ডেইলি স্টার।
কথাসাহিত্যিক ও দিব্য প্রকাশনীর প্রকাশক মঈনুল আহসান সাবের জানান, আমরা সারাবছর বই প্রকাশ করতাম। মেলায় কিছু বেশি বের করতাম। কিন্তু গত বছরের জুলাই থেকে যেভাবে লস দিচ্ছি তাতে নতুন বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। অথচ লেখক সারাবছর লিখবেন, সারাবছর বই বেরুবে এমনই হওয়ার কথা। হচ্ছে না, পাঠক ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। বই বিস্তারে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। আর এখন যে অবস্থা, মেলায় এক চতুর্থাংশ বইও বেরুবে না।
গবেষক ও অনুবাদক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, মেলা একদিকে পুস্তক প্রকাশকদের, অন্যদিকে পুস্তক ক্রেতাদের বিষয়। সবাই জানেন যে নির্বাচনের কারণে এবং রমজান মাসের কারণে মেলার তারিখ এগিয়ে আনা হয়েছে। মেলা হবে গভীর শীতের মধ্যে। এটা আমার জন্য পছন্দের ব্যাপার। কিন্তু এতে অনেকে অসন্তুষ্ট। অনেকে সন্তুষ্টও বটে। মেলার তারিখ ফেব্রুয়ারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে সম্ভবত সবাই সন্তুষ্ট হতো। তাতে রমজান মাসে মেলা কিছু অংশ পড়বে। সব প্রকাশকরা হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। এই পৃথিবীতে কোন জিনিস অবিমিশ্রভাবে সুন্দর হয় না। আমরা যা চাই সেটার প্রতিফলন নানা কারণে বিঘ্নিত হয়। এবারের বইমেলার ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, আমি সবচেয়ে খুশি হবো যদি জাতীয় নির্বাচনকে এগিয়ে জানুয়ারি মাসে সম্পন্ন করে ফেব্রুয়ারি মাসেই অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে বইমেলার বাস্তবায়ন কঠিন হবে। কারণ এর সঙ্গে যুক্ত বাংলা একাডেমিসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়। আয়োজনের গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকে নিরাপত্তার বিষয়টি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি অনেকগুলো মবের ঘটনা ঘটতে। বইমেলায় লেখক প্রকাশক ছাড়াও অনেক শ্রেণীর মানুষের সমাগম হয়। সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচনের পরে বইমেলা হলে অনেকটা স্বস্তি বিরাজ করতো বলে আমার ধারণা। তথাপি ঘোষিত তারিখে মেলা হলে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, যেন কোনো অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে।
গত মেলাও অত্যন্ত হতাশার ছিল। অনুরোধ থাকবে যে সরকারী উদ্যোগে গ্রন্থ উন্নয়নে আরও কিছু কার্যক্রম অনতিবিলম্বে নেয়া হোক যা সামনের মাসগুলিতে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক হবে। বিশ্বাস করতে চাই যে এই সরকার প্রকাশনা শিল্পের পাশে আছে। বিশেষ করে গবেষণামূলক বইয়ের ক্ষীণ ধারাটিকে বাঁচাতে অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে আসবেন কিনা, সেটাই আমার কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন
সূচীপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক সাঈদ বারী বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি বইমেলাকেন্দ্রিক নই, সারাবছর আমার প্রকাশনা সংস্থা 'সূচীপত্র' বই প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু সার্বিকভাবে বইয়ের বাজার খুবই সীমিত হওয়ায় অধিকাংশ প্রকাশক বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনায় অভ্যস্ত। বইমেলার কাছাকাছি সময় বই প্রকাশ করলে প্রকাশকদের পুঁজি কম সময়ের জন্যে আটকে থাকে। এছাড়াও প্রবাসী লেখক এবং স্ব-অর্থায়নে প্রকাশকদের মাধ্যমে বই প্রকাশকারী লেখকরাও বছরের যেকোনো সময় নয়, শুধু বইমেলায় বই প্রকাশে আগ্রহী। কেননা এসময় মিডিয়ায় বই নিয়ে প্রচার-প্রচারণা সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। নির্বাচন ও রোযার অযুহাতে একুশে বইমেলা এগিয়ে আনা অযৌক্তিক। ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচন যথাক্রমে ১৮, ২৭ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হলেও বইমেলা যথারীতি ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে মেলা করলে সেই ঐতিহ্য ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
তিনি আরও বলেন, বাংলা একাডেমি ঘোষিত সময়সীমার প্রতিবাদ করেছি এইজন্যে যে, একুশে বইমেলার প্রধানতম অংশীজন সৃজনশীল প্রকাশকদের সংগঠনগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিশুসাহিত্যিক জুলফিকার শাহাদাৎ বলেন, বই কি শুধু একুশ উপলক্ষে বেরোয়? না। সারাবছরই বই প্রকাশিত হয়। বইয়ের খবর খুঁজতে এখন আর মেলায় যেতে হয় না, কিংবা কিনতেও। তাই বইমেলা এখন মূলত বইবিক্রির হাট না, পাঠক লেখকের মিলনমেলা। এ মেলাকে ঘিরে বাঙালি লেখক পাঠকের যে আবেগ সেটাই ধারণ করে মেলা কমিটি। একুশের আবেগকে যদি আমরা ডিসেম্বরে নিয়ে আসি, তাহলে এতে একুশে বইমেলার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে না। বইমেলার সময় সংক্ষিপ্ত হোক, সেটা মাসব্যাপী হতে হবে কথা নেই। তবুও বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে হোক।
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দিন জানান, বইমেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার তেমন কোন মন্তব্য বা হা-হুতাশ নেই। আমরা সারাবছর বই প্রকাশ করি, তবে কিছু লেখককে হতাশ করতে হবে, যাদের বই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি এই সুযোগে যদি সরকারের মনযোগ বই প্রকাশনার জগতের দিকে একটু ফেরানো যায়, সেটাও একটা অর্জন হবে, কারণ গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় আমাদের মনে হচ্ছেনা যে শিক্ষা-সংস্কৃতির অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বইকে আমাদের রাষ্ট্র আদৌ অগ্রাধিকার দেয়। প্রকাশনা সেক্টর হয়তো করোনা মহামারির সময়েও এতটা বিপর্যয়ে পড়েনি, যতটা এই এক বছরে বাজার বিপর্যয় এবং সরকারী নির্লিপ্ততার শিকার হয়েছে। ডিসেম্বরে মেলা হলে হয়তো অবহেলিত এই সেক্টর মিডিয়া এবং সরকারের কাছে কিছু হলেও অগ্রাধিকার পাবে। গত মেলাও অত্যন্ত হতাশার ছিল। অনুরোধ থাকবে যে সরকারী উদ্যোগে গ্রন্থ উন্নয়নে আরও কিছু কার্যক্রম অনতিবিলম্বে নেয়া হোক যা সামনের মাসগুলিতে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক হবে। বিশ্বাস করতে চাই যে এই সরকার প্রকাশনা শিল্পের পাশে আছে। বিশেষকরে গবেষণামূলক বইয়ের ক্ষীণ ধারাটিকে বাঁচাতে অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে আসবেন কিনা, সেটাই আমার কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
কথাশিল্পী কিঙ্কর আহসান বলেন, এক বছর দুটি মেলা হলে লেখক ও প্রকাশক কারোরই প্রস্তুতি ঠিক থাকে না। আমাদের অধিকাংশ লেখক ফুলটাইম না, পার্টটাইম- ফলে তার পাণ্ডুলিপি তৈরি ও সংশোধন নিয়ে একটা ভাবনা ও সময় প্রয়োজন। আর মেলা মাসব্যাপী হওয়ার দরকার নেই। ১৫ দিনে হলে ভালো। সেই ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারিতে না হলেও জানুয়ারিতে হতে পারে এবারের বইমেলা।
লেখক ও সাংবাদিক আমিরুল মোমেনীন মানিক বলেন, প্রকাশক সারাবছরের জন্যই কাজ করেন, কিন্তু এরপরও বিশেষ একটি মাস তাদের দারুণ প্রণোদনা দেয়। ঈদের সময়ের মতো ব্যাপার। পরিস্থিতি বিবেচনায় বইমেলাকে এগিয়ে আনা যায়। ২০২৫ মেলা করলে দুটি বইমেলা হয়, যেটি বেমানান। এক্ষেত্রে ২০২৬ জানুয়ারিতে বইমেলা হতে পারে।
Comments