নিমতলী, চুড়িহাট্টা থেকে শিয়ালবাড়ি ট্র্যাজেডি, তবু টনক নড়ল না

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম ও পোশাক কারখানায় আগুনে আবারও ঝরে গেল ১৬টি প্রাণ। এই ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পরও অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিকের গুদামের ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে পারেনি ঢাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালে নিমতলীতে ১২৪ জনের প্রাণহানি কিংবা ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১ জনের মৃত্যুর পর পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঝুঁকি সম্পর্কে সবাই জানলেও রাজধানীর আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে অবৈধ রাসায়নিকের গুদাম এবং অনুমোদনহীন স্থাপনার কার্যক্রম চলছেই।
মিরপুরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে নয় ঘণ্টারও বেশি। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ, র্যাব ও স্বেচ্ছাসেবীরা একযোগে এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল এই দুর্ঘটনার জন্য অনুমোদনহীন রাসায়নিক গুদাম ও কাঠামোগত ত্রুটিকে দায়ী করেছেন। মঙ্গলবার রাতে মিরপুরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'বারবার সতর্ক করার পরও অবহেলার কারণে প্রাণহানি ঘটছে।'

জনগণের সহযোগিতা চেয়ে তিনি আরও বলেন, 'আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশজুড়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি। কিন্তু এই অবৈধ গুদামগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। এগুলো প্রতিরোধে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনকে সামাজিক ও আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক রাজধানীকে 'রাসায়নিক বোমার ওপর বসে থাকা একটি শহর' হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক সরানোর প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে এবং একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষ। মিরপুরের ঘটনা প্রমাণ করে, ঢাকা একটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। আর কবে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?'
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ২৭,৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭৯২ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৪ সালে ২৬,৬৫৯টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু ও ৩৪১ জন আহত হন। আর চলতি ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসেই এ ধরনের ঘটনায় ১৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তদন্তকারীরা বিভিন্ন তথ্যভান্ডার উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, শুধু পুরান ঢাকাতেই প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক গুদাম রয়েছে, যার মধ্যে ১৫ হাজারই আবাসিক ভবনে অবস্থিত।
অতীতে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ বা স্থানান্তরের জন্য সরকারিভাবে বেশ কয়েকবার অভিযান শুরু হয়েছিল। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মাঝপথে থেমে গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০১৯ সালে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর অনুরোধে তা স্থগিত করে। পরে আর উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়নি।
২০১০ সালের নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারি কমিটি আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম অপসারণসহ ১৭টি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এর কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং ফাইলটি ১৬ বছর ধরে ধামাচাপা পড়ে আছে।
২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডির পর ফায়ার সার্ভিস আবারও আবাসিক ভবনে রাসায়নিক গুদাম নিষিদ্ধ করা, পুরান ঢাকার সরু গলি অন্তত ২০ ফুট চওড়া করা এবং নির্দিষ্ট দূরত্বে রাস্তার পাশে হাইড্রেন্ট স্থাপনের মতো জরুরি পদক্ষেপের সুপারিশ করে। সেই সুপারিশগুলোও মূলত উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'চুড়িহাট্টার পর আমরা সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছিলাম। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এ ধরনের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসত।'
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের রাসায়নিক আমদানি নীতি এখনো সেকেলে। নয় ধরনের রাসায়নিকের মধ্যে মাত্র তিনটির ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মানা হয়, বাকিগুলো কোনো তদারকি ছাড়াই আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে।
এতগুলো ট্র্যাজেডি, সতর্কতা আর প্রতিবেদনের পরও ঢাকার অলিগলিতে রয়ে গেছে অসংখ্য অবৈধ গুদাম—যেন একেকটি নীরব বোমা, যা আবারও জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়।
Comments