মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার হয়ে ভারতে স্বর্ণপাচার

চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত

প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রামের হাজারী লেন ও নিউমার্কেট এলাকার বেশ কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত এবং তারা চট্টগ্রামকে রুট ব্যবহার করে মিয়ানমার থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় দায়ের হওয়া স্বর্ণ চোরাচালানের মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চোরাচালান চক্রের ২ সদস্য স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।

গত ১৬ জুন কর্ণফুলী উপজেলায় পুলিশ চেকপোস্টে যাত্রীবাহী বাস থেকে সাড়ে ৯ কেজি ওজনের স্বর্ণের চালান জব্দ এবং ২ নারীসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে আসা স্বর্ণের চালান নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাচ্ছিলেন এই ৪ জন। এর একদিন পর স্বর্ণের মূল্য ও মান নিশ্চিত করে কর্ণফুলী থানায় এই ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।

মামলার তদন্তকারীরা জানান, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্বর্ণের চালানটি কক্সবাজারে আসে এবং পরে স্বর্ণ বহনকারীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। 

এর আগেও, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের টেকনাফ রুট দিয়ে ভারতে স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সিন্ডিকেট জড়িত বলে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। এই সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণের চালান ধরা পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়।

তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, চোরাচালানের স্বর্ণ প্রথমে চট্টগ্রামে আসে এবং পরে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সহায়তায় ঢাকার তাঁতিবাজার হয়ে ভারতে পাঠানো হয়। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু স্বর্ণ ব্যবসায়ী মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছে না।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, বসুন্ধরা ধর, কৃষ্ণ ধর, নয়ন ধর ওরফে নারায়ণ এবং টিপু ধর ওরফে অলক। অভিযুক্তরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। টিপু ধর কক্সবাজারে স্বর্ণের কারিগর হিসেবে কাজ করেন।

আসামিদের মধ্যে টিপু ও নারায়ণ বন্দরনগরীর হাজারী লেন ও বিপনি বিতানের (নিউ মার্কেট) ২ স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বিধান ও কৃষ্ণ কর্মকার নামে ২ স্বর্ণ ব্যবসায়ী স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে তারা আদালতকে জানিয়েছেন।

হাজারী লেনে বিধানের স্বর্ণালঙ্কারের দোকান আছে এবং নিউমার্কেটের দ্বিতীয় তলায় কৃষ্ণা কর্মকারের স্বর্ণের দোকান আছে। পুলিশ জানায়, তাদের চোখ ফাঁকি দিতে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপ বা অন্যান্য অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে।

মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) বন্দর শাখা।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ২ আসামি জানান, কক্সবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাপ্পু ধরও এই সিন্ডিকেটের সদস্য এবং টিপু ধর তার দোকানেই চাকরি করেন। ৪ সদস্যকে কক্সবাজার আসতে এবং স্বর্ণের বারগুলো নিয়ে যেতে বলেছিলেন বাপ্পু। তার নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ জন কক্সবাজারে গিয়ে চালানটি গ্রহণ করেন। পরে তারা কৃষ্ণ ও বিধানের কাছে চালান হস্তান্তরের জন্য বাসে করে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। চালানের জন্য বাহকদের নগদ ১৫-২০ হাজার টাকা দেওয়া হত। তবে তার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা।

২ অভিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছেন যে, তারা এর আগেও একইভাবে ৩-৪টি চালান নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছেন এবং সোনার বারগুলো বিধান ও কৃষ্ণকে দিয়েছেন।

পুলিশের তদন্তে অসঙ্গতি, জব্দ হয়নি আসামিদের মোবাইল ফোন

আসামিদের কাছ থেকে শুধু স্বর্ণের বার জব্দ করলেও পুলিশ তাদের মোবাইল ফোন জব্দ করেনি, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি মামলার বাদীর তৈরি করা জব্দ তালিকায় অভিযুক্তদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। 

সিএমপি কর্মকর্তারা বলেছেন যে, কোনো ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্তের মোবাইল ফোন জব্দ করা তদন্তের সাধারণ অংশ, কারণ মোবাইল ফোনে বিপুল পরিমাণ ডিজিটাল প্রমাণ রয়েছে, যা পরবর্তী তদন্তে সহায়তা করে। স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা পুলিশের নজর এড়াতে অ্যাপেই যোগাযোগ করেন। 

তবে এই ঘটনায় নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া, জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের দেওয়া ঠিকানাও ভুল পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জব্দ তালিকা শিকলবাহা ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোবারক হোসেন করেছেন এবং তিনি আসামিদের মোবাইল ফোনের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি। যে কারণে আমি তাদের মোবাইল ফোন জব্দ করতে পারিনি।'

'আর অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন জব্দ করা বাধ্যতামূলক নয়। আমি তাদের ফোন চেক করেছি এবং সেসময় তাদের হোয়াটস অ্যাপ, ইমো এবং অন্যান্য কিছুতে সন্দেহজনক কিছু পাইনি। তাই পরবর্তীতে এগুলো আসামিদের আত্মীয়দের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে', যোগ করেন তিনি। 

ডিবি তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ইন্সপেক্টর মেহেদী এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হিসেবে ১০ দিন তদন্তভারে ছিলেন।

ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়াই তিনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন ফোনে কিছু ছিল না? জানতে চাইলে ইন্সপেক্টর মেহেদী বলেন, 'আমরা সিডিআর নিয়েছি, ফোন চেক করেছি, সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।'

তবে একপর্যায়ে তিনি বলেন, 'ফোন জব্দ থাকলে তদন্তে অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়।'

মামলার বাদী মোবারক হোসেন বলেন, 'আমি ফোন জব্দ তালিকায় না দেখালেও সেগুলো স্যারের কাছে দিয়েছি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাকি কাজ করবেন। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।'

মামলার তদন্তভার নিয়ে পিবিআই-সিএমপির টানাটানি

আলোচিত এই মামলার তদন্তভার নিয়ে পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং সিএমপির মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। পিবিআই ডিবির কাছ থেকে মামলাটি নেওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ তা অস্বীকার করে চিঠি দিয়েছে।

সিএমপি চিঠিতে মামলাটি পিবিআইকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে বলেছে যে, ইতোমধ্যে মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং মূল আসামিদের ধরার চেষ্টা চলছে।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপ-পরিদর্শক (এসআই) রবিউল ইসলাম এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেছেন।

ডিবি বন্দর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আলী হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা মামলাটির অনেক অগ্রগতি করেছি এবং স্বর্ণ চোরাকারবারিদের বেশ কিছু তথ্য ও নাম পেয়েছি। আমরা ২ স্বর্ণ চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি এবং তাদের গ্রেপ্তারের পর অন্য মাস্টারমাইন্ডদের নাম প্রকাশ করা হবে।'

'পিবিআই থেকে চিঠি এসেছিল, এর জবাব আমাদের কমিশনার স্যার দিয়েছেন', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
nahid-ctg

NCP attacked in Cox's Bazar for exposing the truth: Nahid

Hasnat says those who ruled Bangladesh in the past planned escape routes abroad

37m ago