আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য

চিকিৎসা বন্ধ করতে ঢামেক হাসপাতালের ৫ চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছিল

International Crimes Tribunal
ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে উঁচু স্থান থেকে গুলি করা হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) এক চিকিৎসক।

হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোস্তাক আহমেদ আরও জানান, চিকিৎসা বন্ধ করতে গত বছর ২৫ জুলাই দায়িত্বরত পাঁচজন চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছিল।

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আজ মঙ্গলবার মোস্তাক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দুই শীর্ষস্থানীয় সহযোগীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

মোস্তাক সে সময় ঢামেক হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, গত বছরের ১৯-২১ জুলাই এবং ৪-৫ আগস্টের মধ্যে তিনি বিপুল সংখ্যক গুলিবিদ্ধ রোগীর চিকিৎসা করেছেন। যাদের অধিকাংশের বয়স ছিল ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

'কয়েকজন রোগী বলেছেন, তাদের উঁচু স্থান বা হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল। কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গুলি তাদের মাথায় প্রবেশ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা যায় যে, উপর থেকে নিচের দিকে গুলি চালানো হয়েছে। যা সাধারণত নিচ থেকে উপরে বা সমান্তরাল দিকে গুলি চালালে যেমন হয়, তার চেয়ে আলাদা,' বলেন তিনি।

স্মৃতিচারণ করে এই চিকিৎসক আরও বলেন, 'এক বাবা-ছেলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আসে। বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলে অসহায়ভাবে কাঁদতে থাকে।'

তার অভিযোগ, আওয়ামী সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কয়েকজন সহকর্মী গুলিবিদ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় তাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, "এরা সন্ত্রাসী, এদের চিকিৎসা করা উচিত নয়।"

মোস্তাক আরও জানান, চিকিৎসা বন্ধ করতে গত বছর ২৫ জুলাই দায়িত্বরত পাঁচজন চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছিল।

তিনি উল্লেখ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের কাছে অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে রোগীদের পরিচয় জানতে চেয়েছে এবং ছাত্রদের প্রবেশে বাধা দিয়েছে।

'চিকিৎসা চলাকালে সশস্ত্র ছাত্রলীগ কর্মীরা হাসপাতালে ঢুকে আহতদের তথ্য জানতে চাইতো। ছাত্ররা আমাদের অনুরোধ করতো তাদের পরিচয় গোপন রাখতে,' বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ নৃশংসতার জন্য দায়ী উল্লেখ করে এই চিকিৎসক ন্যায়বিচার দাবি করেন।

মোস্তাক ছাড়াও এদিন আরও চারজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ নিয়ে মোট ২৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করলেন আদালত।

ফেনীর ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন আদালতকে জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট ফেনী শহরে বৈষম্যবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সদস্যদের হামলায় দুইবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। একটি গুলি তার ডান গোড়ালি ভেদ করে যায় এবং অন্যটি বাম পায়ের হাঁটুর নিচে লেগে হাড়ে আটকে যায়।

পরে তিনি শুনেছেন, ওই বছরের ৪ আগস্ট ফেনীতে সাত-আটজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। নাসির আরও বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও ওবায়দুল কাদের এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের গুলি করেছিল।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শারিয়ার খান আনাসের নানা সাইদুর রহমান বর্ণনা করেন, আনাস বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয় এবং ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে সে নিহত হয়। তার সঙ্গে আরও চারজন নিহত হয়েছিল।

'আনাস মেধাবী ছাত্র ছিল। সে প্রকৌশলী হতে চেয়েছিল৷ তৎকালীন সরকার তার জীবনের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে,' বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মফিজুর রহমান সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, আহত বিক্ষোভকারীদের শরীর থেকে বের করা তিনটি গুলি তদন্তকারী কর্মকর্তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জব্দ করেছে।

অন্যদিকে আরও ২৩টি গুলি, শটগানের ছররা এবং গুলির খণ্ডাংশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জব্দ
করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মনিরুল ইসলাম।

এসব সাক্ষ্য মিথ্যা বলে দাবি করেছেন পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের স্টেট ডিফেন্স কাউন্সেল আমির হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, ডা. মোস্তাক 'আদর্শিক বিরোধ' থেকে এই সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে ওই চিকিৎসক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

একজন প্রসিকিউটর প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনার কি কোনো আদর্শ আছে? আমির জবাব দেন, আছে—ভালো হোক বা খারাপ।

উঁচু জায়গা বা হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর অভিযোগও অস্বীকার করেন আমির। তবে মোস্তাক নিজের অবস্থান ধরে রাখেন।

প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, তারা আশা করছেন আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের হাজির করা শেষ করা সম্ভব হবে। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ৮১ জন।

এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ আগামী ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

Comments

The Daily Star  | English

UN urges probe after protesters killed in Nepal

The United Nations on Monday demanded a swift and transparent investigation after Nepal police were accused of opening fire on protesters

54m ago