মব ভিকটিম রূপলালের ছেলে জয় স্কুল ছেড়ে এখন...

ছবি: স্টার

রংপুরের তারাগঞ্জ বাজার। ফুটপাতে ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাই করছে ১৪ বছরের জয় রবিদাস। পাশে যন্ত্রপাতি, সামনে কয়েক জোড়া জুতা। এখানেই বারো বছর ধরে বসতেন তার বাবা রূপলাল রবিদাস। গত ৯ আগস্ট মব সন্ত্রাসে বাবার মৃত্যুর পর সেই শূন্য আসনে বসতে হয়েছে ছেলেকে।

জয় ছিল তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। বাবাকে হারিয়ে সেই স্বপ্ন থেমে গেছে তার। সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে নামতে হয়েছে পৈতৃক পেশায়।

শুক্রবার সকালে জয়কে দেখা যায় বাজারের ফুটপাতে বসে জুতা সেলাই করতে।

জয় জানায়, সকাল ১০টায় দোকান খুলে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ করেছি। আয় হয়েছে ২৮০ টাকা। জুতা সেলাই ও রং করতে পারি, তবে জুতা বানাতে জানি না। শিখে নেব ধীরে ধীরে। সংসার চালাতে এখন প্রতিদিনই কাজ করতে হবে।

কথা বলতে বলতে থেমে যায় জয়। চোখ ভিজে ওঠে। 'স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হব। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সব ভেঙে গেছে। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন বাবা। এখন মা, ঠাকুরমা আর দুই বোনকে নিয়ে সংসার চালাতে হবে আমাকে। আমার পড়াশোনা হবে কিনা জানি না, তবে দুই বোনকে পড়াতে চাই।'

জয়ের মা মালতি রানী রবিদাস বলেন, 'সংসারে আর কোনো পুরুষ নেই, জয়-ই এখন ভরসা। কতটুকু আয় করতে পারবে জানি না, তবে সেই আয়ে আমাদের কোনোভাবে বাঁচতে হবে। ছেলেটাকে স্কুলে পাঠাতে না পেরে বুক ফেটে যাচ্ছে। কিছু মানুষ আমাদের সুখ-শান্তি চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছে।'

রূপলালের বড় মেয়ে নুপুর রবিদাস বলেন, 'বাবা বেঁচে থাকলে ছোট ভাইকে স্কুল ছেড়ে ফুটপাতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হতো না। ছোট ভাইয়ের রোজগারে সংসার চলছে—এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ। যদি উপায় থাকতো তাহলে জয়কে কাজ করতে যেতে দিতাম না।'

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবু হানিফ বলেন, ১২ বছর ধরে আমার দোকানের সামনে রূপলাল বসতেন। খুব সৎ মানুষ ছিলেন, সংবাদপত্র পড়তে ভালোবাসতেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার স্বপ্ন দেখতেন। আজ সেই জায়গায় তার স্কুলপড়ুয়া ছেলে বসে আছে—এ দৃশ্য শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়।'

তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল হক বলেন, 'আমাদের ছাত্র জয়কে রাস্তায় জুতা সেলাই করতে দেখে মন ভেঙে গেছে। বাবাকে হারানোর কারণেই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে হলো। এ দৃশ্য সমাজের জন্য এক নিদারুণ শিক্ষা।'

গত ৯ আগস্ট রাতে রূপলাল রবিদাস (৪৮) ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাস (৪৭) ব্যাটারিচালিত ভ্যানে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলায় তাদের ভ্যানচোর সন্দেহে আটক করে স্থানীয়রা। কিছু সময়ের মধ্যেই মব গড়ে ওঠে এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয় দুজনকে।

পরদিন রূপলালের স্ত্রী মালতি রানী রবিদাস তারাগঞ্জ থানায় মামলা করেন, যেখানে অজ্ঞাতনামা ৭০০ জনকে আসামি করা হয়। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 

Comments

The Daily Star  | English
Largest Islamic bank in the making

Largest Islamic bank in the making

The five banks slated for consolidation are First Security Islami Bank, Union Bank, Global Islami Bank, Social Islami Bank and Exim Bank.

11h ago