খাগড়াছড়িতে সহিংসতা

‘ছেলেটা তার সন্তানকে দেখে যেতে পারল না, মামলা করে কী হবে’

তৈইচিং মারমা। ছবি: সংগৃহীত

আর সপ্তাহ খানেক। তারপরই ঘর আলো করে সন্তানের আসার অপেক্ষা। কিন্তু রোববার খাগড়াছড়ির গুইমারাতে গুলিতে নিহত হয়েছেন তুনি মারমার স্বামী তৈইচিং মারমা। স্বামীকে হারিয়ে এখন অথৈই সাগরে ভাসছেন তুনি।

পেশায় চাঁদের গাড়ি চালক ২১ বছরের তৈইচিংয়ের বাড়ি রামসু বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ে। এলাকায় সবার কাছেই প্রিয় তৈইচিং। তার মৃত্যুতে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৈইচিং, তার স্ত্রী এবং মা-বাবা একসঙ্গে থাকতেন।

আজ মঙ্গলবার সকালে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে অসহায়ভাবে বসে আছেন মা দানু মারমা। তাকে ঘিরে আছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা।

তারা জানান, তৈইচিংরা দুই ভাই, বড় ভাই পরিবার নিয়ে বাড়ির পাশেই থাকেন।

মা দানু মারমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তার পড়ালেখার জন্যই আমরা আমাদের আদিবাড়ি রেখে এই এলাকায় এসেছিলাম। ২০১৮ সাল থেকে আমার ছেলে গাড়ি চালাত।'

পারিবারিকভাবেই তাদের গাড়ির ব্যবসা আছে বলে জানান তৈইচিংয়ের বাবা হ্নলাচাই মারমা।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রোববার সকাল ১১টা পর্যন্ত ছেলে বাসাতেই ছিল। আমাদের বাসার সামনে দিয়ে ছেলেরা গেছে বাজারের দিকে। এর আধাঘণ্টা পর ফেসবুকে লাইভে দেখি আর্মির সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, কিন্ত তখনো গুলি চালানোর ঘটনা হয়নি।'

'তৈইচিংয়ের দুপুরে গাড়িতে কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। গাড়ির তেল আনতে রামসু বাজারের দিকে যাচ্ছিল সে। এর কিছুক্ষণ পর শুনি সেখানে গোলাগুলি হয়েছে,' বলেন হ্নলাচাই মারমা।

তিনি আরও বলেন, 'গোলাগুলির শব্দ শুনে আমি ছেলেকে ফোন দিই, কিন্তু ফোনে পাইনি। পরে পরিচিত একজন ছেলের গুলি লাগার কথা জানায়। তাকে উদ্ধার করে বিজিবি হাসপাতালে নিতে বলি।'

'খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছেলের ফোনে কল দিলে ফোন ধরেন থানার ওসি। তিনি বলেন আমার ছেলের ফোন তার কাছে। তখন আর বুঝতে আর বাকি রইল না তার কী হয়েছে,' বলেন তিনি।

মামলা করবেন কি না, জানতে চাইলে হ্নলাচাই মারমা বলেন, 'কার জন্য মামলা করব? কী হবে?  আমি কোনো মামলা করব না। আমরা আমাদের মতো থাকতে চাই। আমি চাই আমার ছেলের বউটাকে যেন সরকার একটা চাকরি দেয়। তার সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। স্বামীকে হারিয়ে সে কীভাবে থাকবে।'

মা দানু মারমা বলেন, 'ছেলের বউয়ের ডেলিভারি হবে আগামী মাসে। ডাক্তার ৯ অক্টোবর তারিখ দিয়েছে। আমার ছেলেটা তার সন্তানকে দেখে যেতে পারল না। আমার সুখের ঘর, সাজানো জীবন শেষ হয়ে গেল।'

ময়নাতদন্তের পর গতকাল সোমবার রাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতিতে তৈইচিং মারমার মরদেহ দাহ করা হয়।

স্কুলশিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গত শনিবার অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরপর সদর উপজেলা, পৌরসভা ও গুইমারা উপজেলায় পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

অন্যদিকে, অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রোববার রামসু বাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে তৈইচিংসহ তিনজন নিহত হন এবং সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন।

আজ সকালে রামসু বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনো সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে। বাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছেন।

জানতে চাইলে গুইমারা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান উসেপ্রু মারমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি পুরো জেলার মধ্যে মারমাদের সবচেয়ে বড় বাজার। এখানে আজকে হাটবার, কিন্তু কিছুই নেই।'

দুপুর দেড়টার দিকে রামসু বাজারে যান জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ কর্মকর্তারা।

জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় মামলা হবে।'

পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, 'দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। নিহতের পরিবার যদি মামলা না করে, তাহলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।'

ত্রাণ নেননি অনেকে

দুপুরে রামসু বাজারে ক্ষতিগ্রস্তদের একাংশকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডাকা হয়। সেসময় সেখানে ডিসির কাছ থেকে ত্রাণ সহায়তা নিতে অস্বীকৃতি জানান অনেকে৷

ভুক্তভোগী শেফালী মারমা বলেন, 'আমার দুটি দোকান পুড়েছে, ঘর পুড়েছে—এর দায় কার? আমার মাকে নিয়ে আমি ৪৫ মিনিট মাঠের মধ্যে পানিতে ছিলাম। কোনো সাহায্য আসেনি। সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৫০ কোটি টাকা দিলেও লাভ নেই, যা গেছে তা ফেরত আনা যাবে না।'

সে সময় ডিসি তাকে বলেন, 'আমরা আপনাদের কথা শুনতে এসেছি, ত্রাণ দিতে নয়।'

এরপর অনেকে ত্রাণ সহায়তা না নিয়ে চলে যান। পরে গুইমারা বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে প্রশাসন।

Comments

The Daily Star  | English
The Costs Of Autonomy Loss of Central Bank

Bangladesh Bank’s lost autonomy has a hefty price

Economists blame rising bad debt, soaring prices and illicit fund flows on central bank’s waning independence

12h ago