লাউয়াছড়ায় গাড়ি পার্কিংয়ে নিষেধাজ্ঞা, নতুন নিয়মে ‘পুরনো প্রশ্ন’

অনেকে সিদ্ধান্ত না মেনে নো পার্কিংয়ের জায়গাতেই করছেন পার্কিং। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

সবুজে ঘেরা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, যেখানে পাখির ডাক মিশে যায় প্রকৃতির সুরে আর বিরল প্রাণী বিনা ভয়ে বিচরণ করে—এ যেন প্রকৃতির এক শান্ত আশ্রয়স্থল। সম্প্রতি এই উদ্যানের প্রবেশপথে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

একদিকে বন্যপ্রাণী রক্ষার স্বার্থে নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে অনেকে স্বাগত জানিয়েছেন। অন্যদিকে পর্যটকেরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। তবে বন বিভাগ বলছে, এটি মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় জন্য মোট আট নির্দেশনার একটি।

বিকল্প না থাকায় লাউয়াছড়া উদ্যানের প্রবেশপথের মূল সড়কেই অনেকে গাড়ি পার্ক করছেন। আবার অনেকে সিদ্ধান্ত না মেনে নো পার্কিংয়ের জায়গাতেই গাড়ি রাখছেন।  

বৃহস্পতিবার উদ্যানে গিয়ে স্থানীয় এবং পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে লাউয়াছড়ার প্রধান ফটকের পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার ব্যবস্থা থাকলেও সম্প্রতি সেই সুবিধা বাতিল করে নো পার্কিং সাইনবোর্ড বসিয়েছে বনবিভাগ। 

এমন পরিস্থিতিতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের নিজেদের গাড়ি বা ভাড়া করা যানবাহন এখন কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের দুইপাশে পার্ক করতে হচ্ছে। এতে তাদের জন্য বড় ধরনের ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। 

সম্প্রতি বন বিভাগ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বারের পাশে 'আই লাভ কমলগঞ্জ' ইংরেজিতে লিখে একটি ফলক তৈরি করেছে। মূলত পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্যই এই উদ্যোগ। তবে, যে জায়গায় ফলক তৈরি করা হয়েছে, আগে সেখানে উদ্যানে আসা পর্যটকেরা গাড়ি পার্ক করে রাখতেন। গত ১ অক্টোবর থেকে কর্তৃপক্ষ গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আসা পর্যটক সাদেক আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা টিকিট কেটে উদ্যানের ভেতর প্রবেশ করি। আমাদের গাড়ি পার্কিংয়ের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না রেখে হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে।'

'এখন আমাদের গাড়ি পার্ক করতে হচ্ছে সড়কের ওপরে। কয়েকজন গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ না পাওয়ায় ফিরে গেছেন। তবে বৃহস্পতিবার লাউয়াছড়ায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অনেক চালককে গাড়ি পার্ক করতে দেখা গেছে।'

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মতিন মিয়া বলেন, 'বনবিভাগ গাড়ি পার্কিং নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর থেকে যানবাহন পার্কিংয়ের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।' 

স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সোহেল শ্যাম বলেন, 'আমাদের আট দাবির মধ্যে এটিও একটি। আমরা অনেক দিন আগে থেকেই এই দাবি জানিয়ে আসছিলাম। তা এখন বাস্তবায়ন করা হলো। এটি পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করবে।'

'এখন ভাবার বিষয় হলো বনবিভাগ আবার যদি বনের কোনো জায়গা পার্কিংয়ের জন্য ঠিক করে দেয়, তাহলে আবার কিছু গাছ কাটা যাবে। এজন্য পার্কিং বনের বাইরেই হলেই ভালো। পর্যটকেরা বন দেখতে আসবেন, কিন্তু কিছুদূর হেঁটে আসবেন না, তা হতে পারে না। আবার এও হতে পারে, লাউয়াছড়া গেটের সামনে যাত্রী নামিয়ে গাড়ি চলে যাবে, আবার এসে নিয়ে যাবে। এসব আলোচনা খুবই পুরোনো।'

লাউয়াছড়া পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বলেন, 'লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যেখানে বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বাস করে। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এবং যানবাহনের আগমন বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যানবাহনের শব্দ, ধোঁয়া এবং মানুষের ভিড় বন্যপ্রাণীর প্রজনন, চলাচল এবং খাদ্য অনুসন্ধানে বাধা সৃষ্টি করছে।'

তিনি আরও বলেন, 'পার্কিংয়ের নামে গাড়ি বনে প্রবেশ করলে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং বনাঞ্চলের ক্ষতি হয়। মূলত বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বনকে বন হিসেবেই রাখতে হলে আমাদের কিছু ছাড় দিতেই হবে। তাই পর্যটকদের পরিবেশবান্ধব আচরণ করতে হবে। তাদের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের সময় নির্ধারিত নিয়ম-কানুন মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।'

তবে তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, 'তাড়াহুড়ো করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য হিসেবে আমি মনে করি, যদি সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, তাহলে তা আরও কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হতো। সবাই এতে উপকৃত হতে পারতেন।'

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন সংরক্ষক আবুল কালাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'মন্ত্রণালয়ের আদেশে লাউয়াছড়ায় গাড়ি পার্কিং বন্ধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের লোকজন এসেছিলেন। তারা ঘুরে দেখার পর বললেন— সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে পার্কিং কেন? লাউয়াছড়ায় তো বন্যপ্রাণী আছে। তাদের আবাসস্থলে গাড়ি পার্কিং হলে বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়। তাই এমন সিদ্ধান্ত।'

তিনি বলেন, 'গত ১৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকের পর লাউয়াছড়া ও সাতক্ষীরা বনের জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা আসে। লাউয়াছড়ার পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় জন্য মোট আটটি নির্দেশনা আসে, তার মধ্যে এটি একটি। নো পার্কিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বন্যপ্রাণী সুরক্ষা ও ট্যুরিস্ট কমানো।'

Comments

The Daily Star  | English

Tug-of-war over water lily continues

The Election Commission and National Citizen Party remain locked in a heated debate over the party’s choice of electoral symbol, the water lily -- a dispute that began in June.

6h ago