ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে ঢাকার রাস্তা

ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য। ছবি: স্টার

রাজধানী ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এই রিকশার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিক্যের পেছনে আছে দুর্বল তদারকি ও কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা না থাকা।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই যানগুলো নগরবাসীর জন্য তুলনামূলক সস্তা ও দ্রুত যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করেছে। একইসঙ্গে হাজার হাজার নিম্নআয়ের মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করেছে।

তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকলে ঢাকার পুরো পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে তৈরি হওয়া এসব রিকশার ব্রেকিং সিস্টেম সুবিধাজনক নয়। অথচ এগুলো খুব দ্রুত গতিতে চালানো হয়, যা যাত্রী ও পথচারী উভয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।

কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই রিকশার চালকেরা প্রায়ই ট্রাফিক সিগন্যাল উপেক্ষা করে দ্রুতগতিতে মোড় পার হয়। এতে ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় প্রায়ই যানজট তৈরি হয়।

তবে কোনো কেন্দ্রীয় নিবন্ধন বা লাইসেন্সিং ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকায় ঠিক কী পরিমাণ ব্যাটারি রিকশা চলছে, তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না।

অবশ্য দুটি অটোরিকশা সংগঠনের নেতাদের হিসাবে, রাজধানীর ৫০টি থানার আওতায় এখন প্রায় পাঁচ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এই পরিসংখ্যান পুরনো প্যাডেল রিকশার সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

আশঙ্কার কথা হলো, এসব রিকশার অনেক চালকেরই মোটরচালিত যান চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তাদের বেপরোয়া গতিতে ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ঈদের সময় (গত ২৪ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত) ঢাকায় ঘটে যাওয়া ৩১৫টি সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ১৫ শতাংশ ঘটেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে।

মিরপুরের বাসিন্দা শামসুল আলম বলেন, ব্যাটারি রিকশার চালকেরা কোনো নিয়ম না মেনে এদিক-ওদিক ছুটে চলে, যা যাত্রী ও পথচারী উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমি একবার ব্যাটারি রিকশায় উঠে দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। এরপর থেকে চালককে সব সময় ধীরে চালাতে বলি। কিন্তু অনেকেই কথা শোনে না। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে।'

একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গাড়িচালক মো. কামাল বলেন, 'ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা এত বেশি যে, গাড়ি চালাতে কষ্ট হয়। তারা রাস্তায় অন্য যানবাহন দেখে না। হুটহাট এদিক ওদিক মোড় নেয়।'

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা শাহিদা কাদের বলেন, প্রায় তিন বছর আগে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা উল্টে তার পায়ে আঘাত লাগে।

'এখনও পুরোপুরি সেরে উঠিনি... এই রিকশাগুলো আমার কাছে এখন দুঃস্বপ্নের মতো,' বলেন তিনি।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. শিফুন নেওয়াজ বলেন, ব্যাটারি রিকশা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে পারে। এই গতি সরু রাস্তায় সহজেই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তিনি রিকশা নির্মাতাদের কঠোরভাবে তদারকি করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'এসব যানবাহনের নকশায় প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতি ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।'

তার ভাষ্য, 'যদি ৩০ কিলোমিটার গতিসীমার রিকশা তৈরি করেন। আর চালকদের বলেন ২০ কিলোমিটার গতিতে চালাতে, তারা কখনোই মানবে না। যেমনটা বাস বা গাড়িচালকদের মধ্যে দেখা যায়। তারাও প্রায়ই গতি-সীমা মানে না।'

তিনি আরও বলেন, কর্তৃপক্ষের এখনই সব অবৈধ চার্জিং স্টেশন বন্ধ করা উচিত। কেবল লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্টেশনেই চার্জের অনুমতি দিতে হবে। অন্যথায় রিকশার সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়।

'এই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে রাস্তায় রিকশার সংখ্যা নিজে থেকেই কমে আসবে, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। এখন তো কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই,' যোগ করেন তিনি।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের তুলনা টেনে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রামের প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা খুব একটা দেখা যায় না। সেখানে কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থানে ছিল। তাই কেউ নিয়ম ভাঙতে সাহস পায় না। কিন্তু ঢাকায় কেবল অস্পষ্ট কথা বলা হয়, কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, তাই সমস্যা থেকে যাচ্ছে।'

কেন এই হঠাৎ বৃদ্ধি

অনেকে বলছেন, ব্যাটারি রিকশা এখন তাদের জীবিকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে।

যেমন ২৬ বছর বয়সী আসিফ মিয়া। আট মাস আগেও তিনি একজন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। মাসে আয় করতেন মাত্র ১২ হাজার টাকা। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো শুরু করেন। এটাই এখন তার জীবিকার মাধ্যম।

তার ভাষ্য, 'এখন দিনে আয় হয় এক হাজার থেকে বারোশো টাকা। আগে আট ঘণ্টা চাকরি করতাম, এখন দিনে বারো-তেরো ঘণ্টা রিকশা চালাতে পারি, তেমন কষ্টও হয় না।'

তার মতো হাজারো নিম্নআয়ের মানুষ এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন।

রাজধানীর পল্লবী, শেওরাপাড়া, ভাসানটেক, আগারগাঁও, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, গুলশান, বনানী ও বাড্ডা এলাকায় বিভিন্ন আকৃতি ও মাপের শত শত রিকশা দেখা গেছে। যেগুলো নিরাপত্তার ন্যূনতম মানও মানে না। কোথাও বড় চার আসনের রিকশা, কোথাও আবার পুরনো প্যাডেল রিকশাতে ব্যাটারি বসিয়ে চালানো হচ্ছে। এসব রিকশার বেশিরভাগের ব্রেকিং সিস্টেম দুর্বল এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি।

ভাসানটেকের কাকলী অটো হাউসের মালিক আবদুল কাদের বলেন, 'ব্যাটারি রিকশা চালাতে দেশের নানা জায়গা থেকে নিম্নআয়ের মানুষ ঢাকায় আসছেন। এটা এখন তাদের জীবিকার একমাত্র উপায়।'

গুলশান-বনানী-বাড্ডা অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালক সমিতির সভাপতি আবদুল জলিল বলেন, 'গত বছরের আগস্টের আগে আমাদের এলাকায় প্রায় তিন হাজার ব্যাটারি রিকশা ছিল। এখন সেটি বেড়ে আট হাজারে দাঁড়িয়েছে। কোনো মনিটরিং নেই বলেই এমনটা হয়েছে। যে কেউ বিনা প্রশিক্ষণে রিকশা চালাতে পারে।'

তিনি নিবন্ধন, লাইসেন্স এবং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান।

কর্তৃপক্ষ কী করছে?

সরকার ইতোমধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে।

'ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনস ২০২৫' খসড়া অনুযায়ী, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ ধীরগতির সব বৈদ্যুতিক যানবাহনকে 'ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার' হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে। এতে মহাসড়কে এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে এবং নিবন্ধন, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও চালকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব মাহবুবা আইরিন জানিয়েছেন, খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

'পরামর্শ পরিষদের অনুমোদন পেলেই এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে,' বলেন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, নীতিমালায় যানবাহনের ফিটনেস মান, চালকদের প্রশিক্ষণ ও নিয়ম ভাঙলে জরিমানা, সব কিছুই যুক্ত করা হবে। এতে 'চালকই মালিক' নীতিও রাখা হবে, যেন একজন ব্যক্তি একাধিক রিকশার মালিক হতে না পারেন।

ইতোমধ্যে সরকার বুয়েটের নকশায় তৈরি নতুন ব্যাটারি রিকশার একটি মডেল পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, নতুন রিকশা এ মাসের শেষ দিকে প্রথমে নিকুঞ্জ, গুলশান, বারিধারা, আফতাবনগর, উত্তরা, ধানমন্ডির কিছু অংশ ও পল্টনে এই নতুন রিকশা চালু করা হবে ।

তিনি বলেন, 'এসব এলাকায় অবৈধ রিকশা শনাক্ত করা সহজ হবে। ধীরে ধীরে আমরা জোনভিত্তিকভাবে পুরনো রিকশা বদলে নতুনগুলো আনব।'

তার ভাষায়, '২০ হাজারের বেশি চালক ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ জন চালক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আমরা নকশা চূড়ান্ত করেছি, খুব শিগগির উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হবে।'

বুয়েটের প্রকৌশলী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সরকারি কমিটি এই রিকশা উৎপাদনের অনুমোদন প্রক্রিয়া তদারকি করবে বলে জানান তিনি।

Comments