বন্যার পর ৪ জেলার ৬০ পয়েন্টে ভাঙন, বেশি ঝুঁকিতে কুড়িগ্রাম

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের তীরে কমপক্ষে ৬০টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
ভাঙনকবলিত স্থানে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে আবাদি জমি, বসতভিটা, ফলের বাগানসহ নানা স্থাপনা। গৃহহীন হয়ে পড়ছে নদীপাড়ের পরিবারগুলো।
ভাঙন আতংকে অনেকে নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে ঘর সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি ভাঙছে কুড়িগ্রামের সদর, নাগেশ্বরী, রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, লালমনিরহাট তিস্তা ও ধরলা তীরে ১২টি, রংপুরের তিস্তাপাড়ে ৮টি ও নীলফামারীর তিস্তাপাড়ে ৬টি পয়েন্টে এবং কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা পাড়ের ৩৪টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভাঙছে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার দুধকুমার নদের তীরে যাত্রাপুর ইউনিয়ন। গত দুদিনে এ ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার নদীভাঙনে বসতভিটা ও আবাদি জমি হারিয়েছেন।
বানিয়াপাড়া গ্রামের মেহের জামাল জানান, গত কয়েক বছরে দুধকুমার নদে সাত বিঘা জমি হারিয়ে ১০ শতাংশ জমির বসতভিটায় বসবাস করছিলেন পরিবার নিয়ে। গতকাল সকালে বসতভিটাটিও চলে গেছে দুধকুমারের উদরে। তিনটি ঘর কোনো রকমে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'হামরা এ্যালা কোনটে যামো। মাটি কেনার সাধ্য হামার নাই। কাই হামাক বাড়ি করা জাগা দিবে। হামরাগুলা এমনতেই গরিব, নদীভাঙনে বাস্তুভিটা হারিয়ে আরও বেশি গরিব হয়া গ্যাইনোং।'
একই এলাকার মোহসেনা বেগম বলেন, 'মোর চোখের সামনোত হামার দুই বিঘা আবাদি জমি ও আট শতাংশ জমির বাস্তুভিটা নদীত চলি গেলো। হামার একটা ঘরও নদীত চলি গ্যাইছে। দুইটা ঘরে মাইনসের জমিত নিয়া ফেলে থুছি। এ্যালা সরকারি রাস্তার ওপর থাকা ছাড়া উপায় নাই। নদীই হামাকগুলাক শ্যাষ করি ফ্যালাইল। এ্যালা ক্যাং করি বাইঁচমো।'
যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, 'মঙ্গলবার ও বুধবার দুইদিনে প্রায় ৫০টি বসতভিটা ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে। একশ বিঘারও বেশি আবাদি জমি ভেঙে নদীতে গেছে। ভাঙন এখনো চলছে।'
ভাঙন আতংকে অনেকে বাড়ি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু ভাঙন ঠেকাতে তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দ্রুত বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানো না গলে আরও শতাধিক বসতভিটা ও কয়েকশ বিঘা আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে যাবে।'
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যাত্রাপুরের ভাঙন ঠেকাতে বিপুল পরিমাণে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলতে হবে, কিন্তু আপাতত এত ফান্ড নেই। রাজারহাট ও উলিপুরে তিস্তাপাড়ে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে।
তিনি বলেন, 'জরুরি ভিত্তিতে কিছু স্থানে ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি বরাদ্দের জন্য পত্র পাঠিয়েছি।'
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর এলাকার কৃষক সুভাষ চন্দ্র বর্মণ জানান, বন্যার পানি নামার পর তিস্তাপাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে যাতে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য তারা ঘরবাড়ি সরিয়ে নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই আবাদি জমি চলে যাচ্ছে তিস্তার উদরে।
হরিণচড়া এলাকার কৃষক আবেদ আলী জানান, তিস্তা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত দুদিনে ১০টি বসতভিটা ও অর্ধশতাধিক আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আরও শতাধিক বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, তিস্তার প্রবল ঘূর্ণিস্রোত তীরে আঘাত হানায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বসতভিটা ও আবাদি জমি। ভাঙনকবলিত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুতি চলছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ বলেন, 'উজানের ঢলে হঠাৎ নদ-নদীর পানি বেড়ে যায় এবং পানি কমার সঙ্গে সঙ্গেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ভাঙন মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ভাঙনকবলিত পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং তাদেরকে জরুরি ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।'
Comments