ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে জেলেরা পান মাত্র ২৫ কেজি চাল

সারা বছরে সাগরে জাল ফেলে তেমন একটা মাছ ধরতে পারেননি পটুয়াখালীর ধুলাসার গ্রামের জেলে মাসুম বিল্লাহ। পাঁচ সদস্যের পরিবারের খাবারের যোগান দিতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা।

এখন তার টিকে থাকার একমাত্র ভরসা নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দেওয়া ২৫ কেজি চাল। যদিও তা এখনো তার হাতে এসে পৌঁছায়নি।

মাসুম বলেন, 'নিষেধাজ্ঞার কারণে আমি বেকার। সরকার নিবন্ধিত প্রতি জেলে পরিবারকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো আমি কিছুই পাইনি। প্রশাসন বলছে, শিগগির চাল আসবে। কিন্তু শুধু চাল দিয়ে তো আর সংসার চলে না! তাহলে তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমি কিনবো কীভাবে?'

কেবল মাসুম একা নন, উপকূলের হাজারো জেলে সরকারের প্রতিশ্রুত সহায়তা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষায় ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা চলবে আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত।

একদিকে অপ্রতুল সহায়তা, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি জেলেদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলেদের আরও শক্তিশালী ও লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা জরুরি।

ধুলাসার গ্রামের আরেক জেলে শাহ আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছয় সদস্যের পরিবারে আমিই একমাত্র আয় করি। গত বছর চালের পাশাপাশি আমি পাঁচ হাজার টাকা অর্থ সহায়তার জন্য আবেদন করেছিলাম কিন্তু চাল ছাড়া কিছুই পাইনি।'

জেলে সম্প্রদায়ের নেতা ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা নিদারুণ অর্থ কষ্টে ভুগছেন। তারা সরকারের কাছে নিষেধাজ্ঞার সময়ে চালের বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি নগদ সহায়তাসহ অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়ার আবেদন করেছেন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহীপুর মাছ অবতরণ কেন্দ্রের মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রাজা আহমেদ রাজু বলেন, 'এমনিতেই জেলেরা দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। শুধু চাল দিয়ে তো আর সংসার চলে না! সরকার যদি কিছু নগদ অর্থের পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও দিতো, তাহলে অন্তত তাদের এতোটা দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। বহু বছর ধরেই তারা চাল ও নগদ অর্থ সহায়তা চেয়ে আসছে। কিন্তু এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে আট দশমিক ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। যা আগস্ট মাসে ছিল আট দশমিক ২৯ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়ায় গৃহস্থালির ব্যয়ও বেড়েই চলেছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের (ডিওএফ) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৭ লাখ নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাত লাখ ৪২ হাজার জেলে সরাসরি ইলিশ আহরণে যুক্ত।

তবে সীমিত বরাদ্দের কারণে এ বছর ছয় লাখ ২০ হাজার জেলে সহায়তা পাচ্ছেন বলে জানান মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক মোয়াদুজ্জামান।

তিনি আরও বলেন, 'গত বছর ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সারা দেশে ১৪ হাজার ১৬৪ টন চাল বিতরণ করা হয়েছিল। এ বছর প্রায় এক হাজার ৩০০ টন বাড়িয়ে ১৫ হাজার ৫০৩ টন করা হয়েছে।'

ফারুক মোয়াদুজ্জামান বলেন, '৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞায় সহায়তা বাবদ চালের পরিমাণ ৪০ কেজি থেকে ৫০ কেজি ও ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় সহায়তা বাবদ চালের পরিমাণ ২৫ কেজি থেকে ৩০ কেজিতে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাজেট সংকটের কারণে অনুমোদন মেলেনি।'

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুর রউফ বলেন, 'বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক সহায়তা ইতোমধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে, ১০ অক্টোবরের মধ্যে বাকি বরাদ্দও শেষ হবে। দুর্গাপূজার কারণে আমাদের কিছুটা দেরি হয়েছে। আমরা চাহিদা দিলেও সীমিত বরাদ্দ পেয়েছি। এখন সেটাই বিতরণ করছি।'

বরাদ্দের ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেই বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। বরাদ্দের পরিমাণ যথেষ্ট না থাকায় সবাইকে সহায়তার অধীনে আনা যায়নি।'

গলাচিপা উপজেলার গোলখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, 'জেলেদের বরাদ্দের চাল এলেও বিতরণ শুরু হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হবে।'

তবে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখতে নিয়মিতই অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।

বরগুনার ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, 'ইলিশ রক্ষা যেমন জরুরি, তেমন জেলেদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করাও প্রয়োজন। সরকারের উচিত চালের পাশাপাশি জেলেদের নগদ সহায়তা দেওয়া।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন অমানবিক পরিস্থিতিতে পড়া জেলেদের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা আরও স্পষ্ট করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, '২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় জেলেদের যে সহায়তা দেওয়া হয় তা স্পষ্টতই অপর্যাপ্ত। শুধু চাল দিয়ে তো কোনো পরিবার টিকে থাকতে পারে না। বাজারে ইলিশ বেশি থাকলেও দাম আকাশ ছোঁয়া। যদিও জেলেরা এর সামান্য মুনাফাই পান। বেশিরভাগই যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।'

'আমরা বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখেছি, নগদ সহায়তা পণ্য সহায়তার চেয়ে বেশি কার্যকর। কারণ এতে পরিবারগুলো অন্য প্রয়োজনে খরচ করার সুযোগ পায়। অনেক জেলে বাধ্য হয়ে চাল বিক্রি করে বাকি প্রয়োজন মেটান। সহায়তা সবচেয়ে কার্যকর হবে যদি চাল ও নগদ সহায়তা দুটোই একসঙ্গে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অতিরিক্ত ৮০ হাজার জেলেকেও এই সহায়তার আওতায় আনা উচিত,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

3h ago