মৌসুমি কর্মসংকটে দিশেহারা রংপুরের কৃষিশ্রমিকেরা

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা গ্রামের বেকার কৃষিশ্রমিকরা। ছবি: এস দিলীপ রায়

রংপুর বিভাগের ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, গঙ্গাধর, তিস্তা ও ধরলা নদী অববাহিকার চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় এখন দিশেহারা হাজারো কৃষিশ্রমিক। 

আমন ধান কাটার মৌসুম শুরু হতে এখনও দুই-তিন সপ্তাহ বাকি। এরইমধ্যে মৌসুমি কর্মসংকট নেমে এসেছে এলাকায়। এর মধ্যে আবার নদীভাঙনে বিপর্যস্ত করে তুলেছে উত্তরাঞ্চলের হাজারো শ্রমজীবী মানুষকে।

প্রতিদিন কাজের খোঁজে মাঠে-ময়দানে ঘুরে ফিরেও তারা কাজ পাচ্ছেন না। সংসার চালাতে কেউ অগ্রিম শ্রম বিক্রি করছেন, কেউবা মহাজনের কাছে উচ্চসুদে ধার নিচ্ছেন। 

অথচ এই সময়েই হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্প (কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিশেষ কর্মসূচি) শুরু হওয়ার কথা ছিল—যা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ধরলা নদী তীরবর্তী বড়ভিটা গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী শ্রমিক মহর আলী বলেন, 'ধান কাটার মৌসুম এখনো শুরু হয়নি, আরও দুই-তিন সপ্তাহ লাগবে। এই সময়ে আমরা পুরোপুরি বেকার। সংসার চালাতে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে টাকা ধার নিতে হচ্ছে।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ধরলা অববাহিকার কুলাঘাট গ্রামের ৪৭ বছর বয়সী শ্রমজীবী আকলিমা বেগম জানান, অক্টোবরের শুরু থেকেই তিনি বেকার হয়ে গেছেন। প্রতিদিন কাজের খোঁজে বের হন, কিন্তু কোনো কাজ মেলে না। তার স্বামী সহির আলীও বেকার। ধারকর্জ করে দিন চালাতে হচ্ছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীতীরের চর মহিপুর গ্রামের ৫২ বছর বয়সী কৃষিশ্রমিক আফতাব উদ্দিন জানান, কাজের মৌসুমে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার হয়। কিন্তু এখন অগ্রিম কাজ বিক্রি করতে হয়েছে ৩০০ টাকায়। সংকটে পড়ে স্থানীয় এক কৃষকের কাছে সাত দিনের কাজ অগ্রিম বিক্রি করেছেন।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে চর যাত্রাপুর গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী দিনমজুর সলেম আলী জানান, গত বছর এই সময় সরকারিভাবে ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পে কাজ পেয়েছিলেন, প্রতিদিন ৪০০ টাকা মজুরি পেতেন। কিন্তু এ বছর এখনো কাজ শুরু হয়নি, কবে হবে তাও জানেন না।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা গ্রামের কৃষক হামিদুর রহমান বলেন, 'অনেক কৃষিশ্রমিক আমার কাছে অগ্রিম টাকা চাইছেন। কিন্তু সবাইকে দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকজনকে দিনে ৩০০ টাকা হারে অগ্রিম দিয়েছি। ধানকাটা শুরু হলে তারা কাজ করবেন।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তাপাড়ের চর কালমাটির ক্ষুদ্র মহাজন মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ধার চাইতে আসেন। সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। কয়েকজনকে অল্প সুদে টাকা দিয়েছি, তারা ধান কাটার সময় কাজ করে পরিশোধ করবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'বর্তমান শ্রমসংকট নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে। তখন আমন ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। প্রতি বছরই অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কৃষিশ্রমিকেরা বেকারত্বে ভোগেন।'

ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার প্রায় ৬৮ হাজার হতদরিদ্র পরিবার সরকারের ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় তালিকাভুক্ত। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ৪০ দিনের জন্য তারা কাজের সুযোগ পান, প্রত্যেক শ্রমিক মোট ১৬ হাজার টাকা মজুরি পান।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এইচ এম মাজাহানুর রহমান বলেন, 'অক্টোবর-নভেম্বরের কর্মসংকট সময়ে হতদরিদ্রদের কাজের সুযোগ দিতে ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্প আছে। কিন্তু এবার এখনো প্রকল্প শুরু হয়নি। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করা হবে।'

কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ডিআরআরও) আবদুল মতিন বলেন, 'এ বছর এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে দ্রুত প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে।'

তিনি আরও জানান, 'এই প্রকল্পের আওতায় শ্রমিকেরা সাধারণত গ্রামের কাঁচা রাস্তা সংস্কার, মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান-শ্মশান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে মাটি ভরাটের মতো কাজগুলো করেন।'

Comments

The Daily Star  | English

‘This fire wasn’t an accident’: Small business owner’s big dreams destroyed

Once a garment worker, now an entrepreneur, Beauty had an export order ready

5h ago