আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ: চরম বাজেট সংকটে থানাগুলো
২৮ সেপ্টেম্বর সকাল। আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে খবর এলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি ময়লার স্তূপে গিয়ে প্রায় ৩০ বছর বয়সী এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পচাগলা মরদেহ পড়ে আছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে।
মরদেহটি জীবাণুমুক্ত করতে ও ব্যাগে ভরতে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে ২ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয়। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহটি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক মনস ভদ্র বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে ৯ হাজার ১০০ টাকা খরচ করেছি। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াই ৭ হাজার টাকা। অথচ হত্যা মামলাটি তদন্তের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৬ হাজার টাকা।'
তার এই বক্তব্য থেকেই পুলিশের প্রতিদিনের আর্থিক সংকট উঠে আসে।
তিনি বলেন, 'আমাকে নিজের পকেট থেকেই টাকা দিতে হয়েছে। এখন ওসিকে খরচের বিষয়ে জানাব। কিন্তু কবে পাব জানি না।'
তিনি জানান, দাফনের আগে মরদেহ দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা পর্যন্ত মর্গেও অতিরিক্ত খরচ হবে।
তিনি বলেন, 'অভিযুক্তদের খোঁজা বা গ্রেপ্তারের আগেই এত খরচ হয়ে যায়।'
অন্যান্য কর্মকর্তারা জানান, এমন আর্থিক ঘাটতির কারণে তাদের অনেক সময় অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগীর পরিবারের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থানা পর্যায়ের 'বিশেষ তহবিল' থেকে খরচ মেটানো হয়।
'বিশেষ তহবিল' সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়েকজন পরিদর্শক ও উপ-পরিদর্শক জানান, এসব খরচ মেটাতে তারা ব্যবসায়ীদের অনুদান বা জামিনে দ্রুত মুক্তি পাওয়া আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া টাকা কাজে লাগান। কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে তদন্ত ব্যয়ের ভার বহন করতে বলা হয়।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, একটি হত্যা বা ডাকাতি মামলার তদন্তে বরাদ্দ থাকে ৬ হাজার টাকা; অপহরণ বা মানবপাচারের মামলায় ৫ হাজার টাকা; অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ৪ হাজার টাকা; নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, মাদক ও সাইবার অপরাধের মামলায় ২ হাজার টাকা; অ্যাসিড নিক্ষেপ, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, অস্ত্র ও বিস্ফোরক এবং মানি লন্ডারিং মামলায় ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকে।
কর্মকর্তারা বলেন, বাস্তবে এসব তদন্তে বরাদ্দের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয় হয় প্রায় সব মামলাতেই।
পুলিশের সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অর্থ) মো. আকরাম হোসেন স্বীকার করেন, তদন্তের জন্য বরাদ্দ বাস্তব চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
তিনি বলেন, 'একটি অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার ও দাফনে প্রায় ৩০ হাজার টাকা প্রয়োজন। অথচ বরাদ্দ থাকে মাত্র ৬ হাজার টাকা। আমরা ইতোমধ্যে তদন্ত ব্যয়ের বিশ্লেষণ শেষ করেছি এবং বরাদ্দ বাড়াতে শিগগির বেতন কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হবে।'
এক প্রশ্নের জবাবে আকরাম বলেন, 'হত্যা মামলার তদন্তের জন্য আমরা ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেবো। অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও এভাবে সমন্বয় করা হবে।'
থানার ব্যয়
২৭ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের একটি থানা একাধিকবার পরিদর্শন করে এর দৈনন্দিন ব্যয়ের চিত্র তুলে এনেছে দ্য ডেইলি স্টার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই থানার ওসি জানান, তদন্ত ও দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্য তারা প্রতি মাসে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে 'সোর্স মানি' হিসেবে ৪০ হাজার টাকা পান।
ওসি বলেন, 'এই টাকার বেশিরভাগই চলে যায় ১৩১ জন কর্মী ও প্রতিদিন আসা প্রায় ২০০ অতিথির আপ্যায়নে। অতিথিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীরাও থাকেন।'
তিনি বলেন, 'গড়ে প্রতি মাসে শুধু আপ্যায়নের জন্যই ৮০ হাজার টাকার বেশি লাগে।'
তিনি আরও বলেন, 'কাগজ, প্রিন্টারের কালি, বাল্ব, টয়লেট সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামে প্রতি মাসে দেড় লাখ টাকা দরকার। অথচ প্রতি চার মাসে ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সম্প্রতি বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার করা হয়েছে। কিন্তু, ট্যাক্স ও ভ্যাট বাদে এ মাসে হাতে এসেছে এক লাখ টাকার কিছু বেশি।'
সরকার প্রতি মাসে থানাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কিছু সরঞ্জাম সরবরাহ করে। তবে প্রয়োজনের অল্প একটি অংশই তারা পায়।
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা একটি নথি অনুযায়ী, একটি থানা ছয়টি প্রিন্টার টোনার, পাঁচটি কীবোর্ড, ২০ রিম এ৪ কাগজ, ২০ রোল টয়লেট টিস্যু, ১৫ ক্যান মশার স্প্রে, ১০ বোতল স্যাভলন ও ১০ প্যাক মশার কয়েলসহ আরও কিছু জিনিস চেয়েছিল।
বিপরীতে তারা পেয়েছে তিনটি প্রিন্টার টোনার, সাত রিম এ৪ কাগজ, আট রোল টয়লেট টিস্যু, তিনটি মশার স্প্রে, দুটি স্যাভলন বোতল ও তিন প্যাক মশার কয়েল। কোনো কীবোর্ড তাদের দেওয়া হয়নি।
এর পাশাপাশি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ভাড়া করতে হয়, ফ্যান বা অন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে টেকনিশিয়ান ডাকতে হয়।
ওসি বলেন, 'একজন বাবুর্চিকে মাসে ১৫ হাজার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে ১০ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। একজন ইলেকট্রিশিয়ান বা মেকানিক একবার এসে মেরামত করলে নূন্যতম ৬০০ টাকা নেন।'
ওসি জানান, আটক ব্যক্তিদের জন্য খাবারের বরাদ্দ প্রতি বেলায় ৩০ টাকা। অথচ একবেলা ঠিকমতো খেতে অন্তত ৮০ টাকা দরকার।
অনেক সময়ই দেখা যায়, পরিবার থেকে খাবার না পাঠালে বন্দিদের যেন না খেয়ে থাকতে না হয়, সেই জন্য থানাকেই সেই খরচ বহন করতে হয়।
এসব খরচ কীভাবে মেটানো হয় জানতে চাইলে ওসি জানান, টাকা আসে বিশেষ তহবিল থেকে। কিন্তু, সেগুলো কোনো আনুষ্ঠানিক উৎস না।
তিনি বলেন, 'ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি জানেন। যখন এসব খরচ মেটাতে অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হয়, তখন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করব কীভাবে?'
ওসি জানান, থানার আটটি যানবাহনের মধ্যে চারটি নিয়মিত বিকল থাকে। বাকি চারটি এত পুরনো যে, দ্রুতগামী গাড়ি বা মোটরসাইকেলের সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, 'একটি থানাকে সারাক্ষণ টহল, মামলা তদন্ত ও অন্যান্য কাজে সক্রিয় থাকতে হয়। কিন্তু এই কাজ করতে যে পরিমাণ টাকার দরকার, তার তুলনায় বরাদ্দ একেবারেই অপ্রতুল।'
ওসি বলেন, 'প্রতিটি টহল গাড়ির জন্য প্রতিদিন ১৫ লিটার তেল বরাদ্দ। এটা একেবারেই অপ্রতুল। তার ওপর আবার অভিযান চালাতে অনেক সময় গাড়ি ভাড়া নিতে হয়। সেটার খরচও ওই বরাদ্দ থেকেই দিতে হয়।'
রাজধানীর আরও কয়েকটি থানার কর্মকর্তারা জানান, ঘাটতি পূরণে স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনুদানের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই।
এক পরিদর্শক বলেন, 'যথেষ্ট বরাদ্দ থাকলে পুলিশকে এসব অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হতো না। এসব টাকা নেওয়ার কারণে বাহিনীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় এবং ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এই ঘাটতি পূরণ না হলে প্রকৃত সংস্কার অধরাই থেকে যাবে।'
যোগাযোগ করা হলে অতিরিক্ত আইজিপি আকরাম হোসেন বলেন, 'থানাগুলোর বরাদ্দ বাড়াতে আমরা একটি বাজেট প্রস্তাব তৈরি করছি। শিগগির এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।'
গত ২৯ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চায়, থানাগুলোর বাজেট বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের আছে কি না। তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
সংস্কারের সুপারিশ
জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশ সংস্কার কমিশন এমন কিছু উদ্যোগের সুপারিশ করেছে, যা থানাগুলোর আর্থিক ও কার্যক্রমগত সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে।
এতে থানাগুলোর পরিচালন ভাতা বাড়ানো, ক্রয় কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি নিরীক্ষা ও পরিদর্শন শাখা গঠন এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলার পুলিশ সুপারদের সরাসরি তহবিল বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে তদন্তের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি, থানার আসবাবপত্র কেনা ও মেরামতের জন্য বাজেট নির্ধারণ এবং গাড়ি ও জ্বালানির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, 'পুলিশকে যদি নিয়মিত কাজের খরচ অনানুষ্ঠানিক বা বেআইনি পথে মেটাতে হয়, তাহলে তাদের কাছ থেকে কীভাবে জনকল্যাণমূলক কাজ প্রত্যাশা করবেন?'
তিনি আরও বলেন, 'থানার তদন্ত ও পরিচালন কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।'


Comments