ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিতে শিশুরা: গবেষণা

ছবি: স্টার

ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ায় বাংলাদেশে শিশুদের নিরাপত্তা ক্রমেই ঝুঁকির মুখে পড়ছে। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত এক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) 'বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২৫' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু-সংক্রান্ত ১ হাজার ৮৬৭টি নেতিবাচক সংবাদ প্রতিবেদনের মধ্যে ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। এই তথ্য শিশুদের যৌন ও জীবন নিরাপত্তার ওপর ভয়াবহ ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয় এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের গুরুতর মাত্রা তুলে ধরে।

আজ রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এমজেএফ, স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক (স্ক্যান) বাংলাদেশ ও মানবাধিকার সংগঠন সচেতন সংস্থা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।

গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে স্ক্যান বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মুকুল বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শিশু-সংক্রান্ত মোট ১ হাজার ৪৮৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ প্রতিবেদন দুর্ঘটনা ও ট্র্যাজেডি নিয়ে।

তিনি বলেন, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, ভবন থেকে পড়ে যাওয়া এবং খেলাধুলার সময় মৃত্যু।'

বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছিল ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ, শিশু পাচার ও যৌন নিপীড়ন ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, শিশু স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং শিক্ষা খাতে ঝুঁকি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ হাজার ৮৬৭টি নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশই দুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ঘটনা।

আঞ্চলিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ ও দুর্ঘটনার সংখ্যায় ঢাকা বিভাগ শীর্ষে রয়েছে। এই বিভাগে ২৯৮ জন নিহত, ২৮৪ জন শিশু আহত ও ২ হাজার ৩৭৬ জনকে ভুক্তভোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের সুপারিশ অংশে মনিরুজ্জামান মুকুল বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে শিশু অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে।

২০২৫ সালের এ উপাত্তের ভিত্তিতে শিশু সুরক্ষাকে 'জাতীয় জরুরি অবস্থা' আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, 'শিশুদের রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে কঠোর আইন ও রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকায় শিশুদের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।'

শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে সব ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

সচেতন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সাকিলা পারভীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আরজু আরা বেগম।

তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি সংবাদপত্রের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়ায় এটি জাতীয় পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না, তবে এর ফলাফল ভীতিকর।

'শিশু কল্যাণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ৬৬ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় করা হচ্ছে', যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, শিশুবিষয়ক একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

মুক্ত আলোচনায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বর্তমান পরিস্থিতিকে 'অত্যন্ত উদ্বেগজনক' বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, আগে শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করাকেই সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হিসেবে দেখা হতো। এটি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আমাদের জোরালোভাবে দাবি জানাতে হবে—কোনো অবস্থাতেই শিশুদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না।'

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে শিশু বিষয়গুলো উপেক্ষিত ছিল এবং ওই সময় শিশুদের জন্য কার্যকর কোনো পরিকল্পনা দেখা যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, 'পথশিশু, শিশু শ্রমিক এবং স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ।'

উপাত্ত অনুযায়ী, ২২০টি ইতিবাচক সংবাদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল শিশু ধর্ষণের বিপরীতে আইনি পদক্ষেপ বিষয়ক। সর্বোচ্চ ৫৫ দশমিক ৯০ শতাংশ সংবাদ ছিল উৎসব, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ত্রাণ কার্যক্রমবিষয়ক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ উচ্চ হার ইঙ্গিত করে যে শিশু-সংক্রান্ত উদ্যোগগুলো এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকারভিত্তিক ও প্রতিরোধমূলক নয় বরং ইভেন্ট কেন্দ্রিক ও স্বল্পমেয়াদি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন—কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক জুলিয়া জেসমিন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক রতন কুমার হালদার, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ক শরিফ জামিল এবং নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অন স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের প্রোগ্রাম কর্মকর্তা হালিমা বেগম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সচেতন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সাকিলা পারভীন।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body taken to Parliament Complex ahead of janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

2h ago