চলে গেলেন খালেদা জিয়া

খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। আজ মঙ্গলবার ভোর ছয়টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেন।

মৃত্যুর সময় খালেদা জিয়ার শয্যাপাশে ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় হাসপাতালে আরও উপস্থিত ছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান এবং প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শার্মিলী রহমান সিঁথি।

স্বজনদের মধ্যে ছোট ভাই শামীম এসকান্দার ও তার স্ত্রী, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও শেষ সময়ে হাসপাতালে ছিলেন। এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকেরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

শামসুদ্দিন দিদার জানান, খালেদা জিয়ার জানাজার সময়সূচি ও দাফনের বিষয়ে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। পাশাপাশি কিডনি, ফুসফুস, হার্ট ও চোখের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাও ছিল তার।

হার্ট ও ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে গত ২৩ নভেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসা তদারকি করেন।

এই মাসের শুরুতে চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পরবর্তীতে তা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনি এক শক্তিশালী রাজনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে তার এই যাত্রা শুরু হয়।

১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তার নেতৃত্বেই দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তিত হয় এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও চালু করা হয়।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে সংসদের বাইরে থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন খালেদা জিয়া। সেই সময় তার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া চলছিল।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি দুর্নীতি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে তিনি অস্থায়ী মুক্তি পান। এরপর থেকে তাকে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

১৯৪৫ সালে জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়া দিনাজপুর মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।

খালেদা জিয়ার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ব্যবসায়ী এবং মা তায়েবা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। তার ডাকনাম ছিল 'পুতুল'।

১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহ করে যুদ্ধে অংশ নেন। সেসময় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের পর তিনি মুক্তি পান।

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর তীব্র নেতৃত্ব সংকটে পড়ে বিএনপি। ঠিক সেই সময় কখনো রাজনীতিতে না আসা খালেদা জিয়া দলটিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি সহসভাপতি হন। একই বছরের ১০ মে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে তিনি পুনরায় চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি।

এরশাদ সরকার তার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং বহুবার আটক করে। তবুও খালেদা জিয়া নির্ভীকভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান, হয়ে ওঠেন 'আপসহীন নেত্রী'।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী হয়। খালেদা জিয়া টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জয়ী হন।

১৯৯১ সালের ২০ মার্চ খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি নতুন শাসনব্যবস্থার অধীনে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। তবে বড় সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল।

বিরোধী দলগুলোর দাবির মুখে তৎকালীন সরকার সংসদ নির্বাচন তদারকির জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সাংবিধানিক সংশোধনী আনে।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালুর পর সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এরপর ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয় আওয়ামী লীগের কাছে।

১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়।

২০০১ সালের ১০ অক্টোবর খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার হন।

পরে কারামুক্ত হন খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও তার দল জয়ী হতে পারেনি।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় ১৯৯১ সালের পর এই প্রথম দলটি সংসদের বাইরে থাকে।

জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ঢাকার বিশেষ আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

ওই বছরের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট তার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। পরে তিনি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাতেও দণ্ডিত হন।

করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। শর্ত ছিল—তিনি গুলশানের বাসায় থাকবেন এবং দেশ ত্যাগ করবেন না।

চলতি বছরের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাকে দণ্ডমুক্ত ঘোষণা করলে বিএনপি চেয়ারপারসন সম্পূর্ণ মুক্তি পান।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s body taken to Parliament Complex ahead of janaza

Janaza will be held at Manik Mia Avenue at 2pm

3h ago