বিদায় খালেদা জিয়া

কোটি মানুষের চোখের পানি আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক আইকন বেগম খালেদা জিয়া।

২০২৫ সালের শেষ দিনটিতে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও এর আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লাখো মানুষ অংশ নেন তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রীর জানাজায়। বুধবার দুপুর ২টায় জানাজার সময় নির্ধারণ করা ছিল। এদিন সকাল থেকেই খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে মানুষের ঢল নামে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সংসদ ভবনের সামনের মাঠসহ আশপাশের এলাকায়।

দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভোগার পর ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন খালেদা জিয়া। গত ২৩ নভেম্বর তাকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ কিডনি, ফুসফুস, হৃদ্‌যন্ত্র ও চোখের নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। তার হৃদ্‌যন্ত্রে পেসমেকার এবং স্টেন্টও স্থাপন করা হয়েছিল।

তার মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরা হাসপাতালটির আশপাশের সড়ক এবং ঢাকায় বিএনপির কার্যালয়ের আশপাশে ভিড় করতে থাকেন। তারা দোয়া করেন, নীরবে কাঁদেন।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দলটির প্রবীণ নেতারা যেভাবে শোক প্রকাশ করেছেন, তা স্পষ্ট করেছে যে তারা যেন আবারও অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'আমাদের যখন তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখনই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।'

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর বড় ছেলে তারেক রহমান তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীর প্রশ্নে নিঃসন্দেহে প্রথম নাম। ২০০৮ সাল থেকে নির্বাসনে থাকা তারেক রহমান লন্ডন থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের পর একাধিক মামলায় খালাস পান তিনি এবং ২৫ ডিসেম্বর স্ত্রী ও কন্যাসহ দেশে ফিরেছেন।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুকালে তারেক রহমান ছাড়াও পাশে উপস্থিত ছিলেন তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শারমিলা রহমান, তারেক রহমানের মেয়ে জায়মা রহমান এবং প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর ছোট মেয়ে জাহিয়া রহমান।

তারেক রহমানের ছোট ভাই কোকো ২০১৫ সালে মারা যান। সে সময় খালেদা জিয়া কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং বলতে গেলে একাকী আদরের ছোট সন্তান হারানোর শোক বয়ে চলেছিলেন।

খালেদা জিয়ার জানাজার আগে তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অতি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে কেবল বলেন, খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালে যদি কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে তারা যেন তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন। খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালে তার কোনো ব্যবহারে, কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। 'দোয়া করবেন। আল্লাহ তায়ালা যাতে ওনাকে (খালেদা জিয়া) বেহেশত দান করেন।'

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক খালেদা জিয়ার জানাজা পড়ান।

জানাজায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ আরও কয়েকজন উপদেষ্টা।

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানেরাও জানাজায় অংশ নেন।

খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালা নন্দা শর্মা, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিজিতা হেরাথ ও ভূটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিয়নপো ডি. এন. ধুংগেল এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্টের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিক।

১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মা তৈয়েবা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। খালেদা জিয়ার ডাকনাম পুতুল। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন, যিনি পরে দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং বিএনপি গঠন করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে যুদ্ধে অংশ নেন। খালেদা জিয়া তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হেফাজতে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের পরই তিনি ঢাকায় মুক্তি পান।

১৯৮১ সালে তার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর যখন বিএনপি নেতৃত্বশূন্য ও বিভক্ত, তখনই তিনি এগিয়ে এসে দলের হাল ধরেন। তখন তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল খুবই সীমিত এবং দলের মধ্যেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় তাকে।

অভিজ্ঞ অনেক জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা সেসময় তার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বিচারপতি আবদুস সাত্তার অপসারিত হওয়ার পর দলটি ভাঙনের মুখে পড়ে। এই অভ্যন্তরীণ সংশয় ও এরশাদের সামরিক শাসনের প্রবল শক্তির মধ্যেও তিনি ১৯৮৪ সালে দলের হাল ধরেন। হয়ে ওঠেন এক বিস্ময়কর দৃঢ় নেত্রী।

১৯৮০-এর দশকে ঢাকার রাজপথে খালেদা হয়ে ওঠেন 'আপসহীন নেত্রী'। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনো ধরনের সমঝোতায় না যাওয়ায় তাকে এই উপাধি দেওয়া হয়। বারবার গ্র্রেপ্তার করা হলেও অনমনীয়তাই হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। যার পরিণতিতে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি পায় অভূতপূর্ব বিজয় এবং তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

আধুনিক গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় খালেদা জিয়ার শাসনামলেই। তিনি প্রথমবার ক্ষমতায় এসে প্রচলিত রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্ব দেন।

রাজনীতির কঠিন এই বন্ধুর পথে চলার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তবুও সাধারণ গৃহবধূ থেকে ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসে তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অনন্য চরিত্রে পরিণত হন।

জিয়া উদ্যানে স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সমাহিত করা হয়। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের মাধ্যমে খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে সব প্রধান বিরোধী দল সেই নির্বাচন বর্জন করে। পরবর্তীতে তিনি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত সংশোধনী প্রণয়নে সম্মত হন, যা আওয়ামী লীগ সরকার বাতিল করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচিত ছিল।

১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও ২০০১ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তবে এই মেয়াদটি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক সমান্তরাল ক্ষমতাকাঠামোর জন্য চিহ্নিত হয়ে আছে। একই সময়ে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; পাশাপাশি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়াকেও কারাগারে পাঠায়। ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর ২০২৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে বিএনপি আর ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি। এই সময়কালের তিনটি নির্বাচন ব্যাপকভাবে কারচুপির অভিযোগে সমালোচিত হলেও খালেদা জিয়া এমন এক রাজনৈতিক শক্তি, যাকে নীরব করতে শাসকগোষ্ঠী একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

২০১৮ সাল থেকে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তার দল ও পরিবারের সদস্যরা উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দেওয়ার আহ্বান জানালেও শেখ হাসিনার সরকার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের একমাত্র বন্দি হিসেবে দীর্ঘদিন থাকার পর ২০২০ সালে করোনা মহামারির চূড়ান্ত সময়ে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি করা হয়।

স্বামীহারা এই মানুষটি জীবদ্দদশায় ছোট ছেলেটাকেও হারিয়েছেন, বড় ছেলে ও পরিবার থেকেও ছিলেন বহু দূরে। অন্যায়ভাবে সাত বছরের বেশি সময় নির্জন কারাগারে ও গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৪ সালের আগস্টে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা। দেশের কোটি মানুষ হাসিনার পতন উদ্‌যাপন করলেও খালেদা জিয়া কোনো ধরনের ব্যক্তিগত উল্লাস প্রকাশ করেননি বা প্রতিশোধপরায়ণতামূলক একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

এত অত্যাচার ও ত্যাগের পরও তিনি তিক্ত রাজনীতি নয়, বরং শান্তির আহ্বান জানিয়ে এক পথপ্রদর্শক কণ্ঠস্বর হিসেবেই ছিলেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

বেগম খালেদা জিয়া চলে গেলেন। কিন্তু নিজ কর্মগুণে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি রয়ে যাবেন চির অম্লান হয়ে।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

7h ago