ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবি বিএনপির জন্য ‘কঠিন বার্তা’

জাতীয় নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভরাডুবি বিএনপির জন্য একটি 'কঠিন বার্তা' বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হওয়া প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোর একটি ছিল ছাত্রদল। অথচ, এ বছর সংগঠনটি কেন্দ্রীয় ২৮টি পদের একটিতেও জিততে পারেনি।
বিপরীতে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ডাকসু নির্বাচনে ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতে জয়ী হয়েছে, যা স্বাধীনতার পর থেকে সংগঠনটির সবচেয়ে বড় সাফল্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্যান্য বড় ছাত্রসংগঠনের নির্বাচনের আগে এমন ভরাডুবির পর ছাত্রদলে ব্যাপক সংস্কারের দাবি রাখে। কেননা, ঐতিহ্যগতভাবে জাতীয় নির্বাচনে ছাত্রদল মূলদলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ডাকসুতে ছাত্রদলের পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সাংগঠনিক দুর্বলতা, দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতি, নেতা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের বয়সের পার্থক্য এবং হলগুলোতে অকার্যকর প্রচারণাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, 'এটা শুধু ছাত্রসংগঠনের নির্বাচন নয়, বরং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি কঠিন বার্তা বহন করছে।'
তিনি বলেন, 'সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিএনপি ও ছাত্রদলের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। অনেকের মনে করেছে, তারা যদি ছাত্রদলকে ভোট দেয় এবং জেতায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি শক্তিশালী হবে। এটা তারা চায়নি। কারণ, দলটি ইতোমধ্যেই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। এই ভয়ের কারণেই ছাত্রদল হেরেছে।'
গত বছরের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতা থেকে ছাত্রলীগ বাদ পড়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে শিবির।
এই নির্বাচনে ছাত্রদলের ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেনি, বরং জাতীয় পর্যায়ে দলটির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে বলে দলীয় নেতা ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই পরাজয় থেকে বিএনপি শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলে সামনে ফল হবে ভয়াবহ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'ডাকসু নির্বাচন বিএনপির জন্য একটি শিক্ষা। দলটি যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে দেখছিল, সেখানে এখন পরিবর্তন আসতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে কৌশলগতভাবে কাজ করতে হবে।'
অধ্যাপক হাসানুজ্জামান ও অধ্যাপক মজিবুর উভয়েই মনে করেন, ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি সারা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়বে। জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন দেখিয়েছে যে, এখন বিএনপিই তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত হয়েছেন যে, এই নির্বাচনের পর জামায়াত নতুন গতি পেয়েছে এবং বিএনপিকে এই বাস্তবতায় আরও মনোযোগ দিতে হবে।
অধ্যাপক হাসানুজ্জামান বলেন, 'শিবিরের জয় জামায়াতকে বিপুল শক্তি যোগাবে। অবশ্যই এটি তাদের জন্য সুখবর। বিএনপিকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সামনে এগোতে হবে।'
বিশ্লেষকদের মতে, চাঁদাবাজি, ব্যবসা দখল ও দলীয় কোন্দল ইতোমধ্যেই বিএনপির ভাবমূর্তিকে সংকটে ফেলেছে—যার প্রতিফলন ডাকসু নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিএনপি নেতা বলেন, 'রাজনীতিতে জনমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডাকসু নির্বাচনের ফল মানুষের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ছাত্রদলের হার আর বিএনপির হারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।'
অধ্যাপক মজিবুর মনে করেন, এই ফল জনমনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, 'ডাকসু জেতার পর শিবির নেতারা এখন আলোচনায়। জাতীয় নির্বাচন এলে তারা এলাকায় ফিরে তাদের এই অর্জনকে কাজে লাগিয়ে ভোট চাইবে এবং এর প্রভাব নির্বাচনে পড়বেই।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য বলেছেন, তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে কাজ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, 'বিএনপি বেশ ভালোভাবে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের এই হার সেটা অনেকটাই খর্ব করেছে। এই ব্যর্থতায় অনেক কর্মী হতাশ হয়েছেন। ডাকসুতে ছাত্রদলের পরাজয়ের মাত্রা অত্যন্ত হতাশাজনক।'
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, 'আমি মনে করি, এটি বিএনপির জন্য বড় শিক্ষা। আগামী দিনে আমরা সাংগঠনিক দুর্বলতা খুঁজে বের করে সামনে এগিয়ে যাব।'
অধ্যাপক মজিবুরের মতে, বিএনপির বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী খুবই দুর্বল এবং দলটি এই জায়গাটাকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনও মনে করে না।
তিনি বলেন, 'বিএনপি ও ছাত্রদল বড় বড় কথা বলে, মিছিল করে। কিন্তু ফলাফল সবার সামনে স্পষ্ট। এখন দলটির উচিত সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেওয়া।'
চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গতকাল অভিযোগ করেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগসাজশ করে শিবির ডাকসু নির্বাচনে জয় পেয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য খন্দকার মোশাররফ জোর দিয়ে বলেন, 'এই ফল জাতীয় নির্বাচন বা রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।'
Comments