জরিপের ভিত্তিতে বিএনপির মনোনয়নের পরিকল্পনায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নিজেদের গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপ্রার্থী বাছাই শুরু করেছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে। এতে অনেক তৃণমূল নেতা উদ্বিগ্ন ও অসন্তুষ্ট।
জেলা পর্যায়ের নেতারা বলছেন, তারা আর এই প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তারা বলছেন, অতীত নির্বাচনে একাধিক জরিপের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়েছিল।
তাদের আশঙ্কা, তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ বাড়বে এবং নির্বাচনের আগে দল দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিএনপির গঠনতন্ত্রে বলা আছে, সংসদীয় বোর্ড হিসেবে স্থায়ী কমিটিকে অবশ্যই ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, থানা বা জেলা কমিটির গঠিত প্যানেল থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনীত করতে হবে।
তাছাড়া, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯০বি (৪) ধারায় সংসদীয় প্রার্থীদের মনোনয়নে তৃণমূলের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
দলীয় নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, দল যদি দলীয় গঠনতন্ত্রই অনুসরণ না করে, তাহলে কীভাবে তারা ইশতেহার ও নির্বাচনসূচি ঘোষণার পর নির্বাচনী আইন মেনে চলবে?
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. আব্দুল আলিম বলেন, 'তৃণমূল থেকে না করে কেন্দ্র থেকে প্রার্থী নির্বাচিত হচ্ছে। দলের ভেতরে গণতন্ত্র মানা হচ্ছে না।'
স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, গঠনতন্ত্রের প্রক্রিয়া উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্তত দুই ডজন তৃণমূল নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশনায় পরিচালিত জরিপের মাধ্যমেই মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় তারা এ বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন।
মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে মনোনয়নপ্রার্থী বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএ জিন্নাহ কবির, 'আগে ইউনিয়ন ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত জানাতেন। সেটা আর হচ্ছে না। এখন তারেক রহমান জরিপ চালাচ্ছে এবং এরই মধ্যে দুই ধাপে জরিপ হয়েছে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুরের দুজন বিএনপি নেতাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই ধরনের হতাশা প্রকাশ করেন।
মুন্সিগঞ্জের ওই নেতা বলেন, দল শীর্ষ নেতাদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করছে, স্থানীয় নেতাদের উপেক্ষা করছে এবং উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত ধরে নিচ্ছে। এর ফল মারাত্মক হতে পারে।
শরীয়তপুর জেলার ওই নেতা বলেন, তিনি তার এলাকায় প্রার্থী হলেও দল তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এই জরিপ প্রক্রিয়াকে আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব? একজন নেতা হিসেবেও আমারও জানার অধিকার আছে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি না কী হচ্ছে।'
সিলেট-৩ আসন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'আমি শুনেছি জরিপ হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে হচ্ছে বা ফলাফল কী, কিছুই জানি না।'
তিনি তারেক রহমানকে আহ্বান জানান, যাতে মনোনয়ন অবশ্যই দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে হয়।
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব ও কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে মনোনয়নপ্রার্থী জাকির হোসেন সরকার সতর্ক করে বলেন, যদি অন্য কোনো দলের কেউ 'হাইব্রিড' হিসেবে ঢুকে মনোনয়ন 'কিনে নেয়', তাহলে তৃণমূল সেটা মেনে নেবে না।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আমিনুর রশিদ ইয়াসিন জরিপভিত্তিক প্রক্রিয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, 'কাগজে-কলমে থাকলেও তৃণমূল প্যানেলের মাধ্যমে মনোনয়নের কোনো প্রথাই ছিল না।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও জরিপভিত্তিক প্রক্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন।
তিনি বলেন, 'আমরা শুধু একটি দিক ধরে জরিপ করছি না, দুই-তিনটি দিক থেকে একাধিক জরিপ করছি। এগুলো পরিচালনা করছে পেশাদার প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক লোকজন নয়। এই জরিপ একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কোনো সিদ্ধান্ত একটি নির্দিষ্ট জরিপের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয় না।'
দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে চলা হবে। এগুলো করার জন্য এখনো সময় আছে।'
তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আলিম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ রাজনৈতিক সংস্কার ও ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা করেছিল, কিন্তু 'এখনো কিছু দৃশ্যমান নয়। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে কোনো পরিবর্তনই আসবে না।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, জরিপ প্রক্রিয়াটি লন্ডনভিত্তিক মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের সংযোগ, সেতুবন্ধন, যোগসূত্র, সমন্বয় ঠিকভাবে হচ্ছে না।'
তিনি উল্লেখ করেন, জরিপের পূর্বাভাস প্রায়শই ভুল প্রমাণিত হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা বলেন, যেখানে নির্বাচনের ফলাফলে ছাত্রদলের ভরাডুবি হয়েছে।
মজিবুর সতর্ক করে বলেন, 'যদি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা দলের জন্য ক্ষতিকর হবে।'
Comments