জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা, এনসিপিতে ভাঙনের সুর
জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনের ঠিক আগে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দলের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা পদত্যাগ করেছেন। আদর্শিক কারণ দেখিয়ে আরও অন্তত ৩০ জন কেন্দ্রীয় নেতা দলের আহ্বায়ককে চিঠি দিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
গতকাল শনিবার দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা পদত্যাগ করেছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার যুগ্ম সম্পাদক মীর আরশাদুল হক পদত্যাগ করেন। দলীয় সূত্র বলছে, আরও কয়েকজন নেতা পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জামায়াতের সঙ্গে জোট বা সমঝোতা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং দলীয় আদর্শের পরিপন্থী হবে—এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে চিঠি দিয়েছেন অন্তত ৩০ জন কেন্দ্রীয় নেতা।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'আমাদের আপত্তির ভিত্তি হলো দলের ঘোষিত আদর্শ, জুলাই অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা এবং গণতান্ত্রিক নৈতিকতার মৌলিক প্রশ্ন।'
চিঠিতে নেতারা অভিযোগ করেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বিভাজনের রাজনীতি, অনুপ্রবেশ, অন্তর্ঘাত, এনসিপির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অপপ্রচার এবং নারী সদস্যদের ওপর অনলাইনে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়েছে।
এ ছাড়া ১৯৭১ সালে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা, গণহত্যায় সহযোগিতা এবং যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে দলটির অবস্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও এনসিপির মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ওপর জোর দিয়ে নেতারা বলেন, 'আমাদের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজকে মানবাধিকার, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা, নাগরিক অধিকার এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিকে এগিয়ে নেওয়া। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যেকোনো জোট এই নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে এবং আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করবে।'
চিঠিতে নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে তারা সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতের দ্বিমুখী আচরণের সমালোচনা করেছিলেন এবং ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে 'গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট' গঠন করেছিলেন। প্রায় ১ হাজার ৫০০ মনোনয়নপত্র বিক্রি এবং ১২৫ জন প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর এখন সামান্য কিছু আসনের জন্য জোট করলে তা জাতির সঙ্গে প্রতারণা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
নেতারা বলেন, যদি মধ্যপন্থী সমর্থকেরা সরে যান, তবে দল তার মধ্যপন্থী ভিত্তি হারাবে। এটি এনসিপির স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তারা জামায়াতের সঙ্গে যেকোনো জোটের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'কৌশল নির্ধারণ হতে হবে নীতির ভিত্তিতে; কৌশলগত কারণে নীতি বিসর্জন দেওয়া যায় না।'
এনসিপি সূত্র জানায়, গত দুই মাস ধরে দলটি এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদীর হত্যাকাণ্ডের পর দলের অবস্থানে পরিবর্তন আসে। এরপর থেকে এনসিপি নেতাকর্মীদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে এনসিপির অবস্থান সুসংহত করতে বড় কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেন শীর্ষ নেতারা।
পদত্যাগকারী নেতা তাসনিম জারা ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারী ছিলেন না। তবে গতকাল ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি ঢাকা-৯ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এনসিপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
ঢাকা-৯ আসনের বাসিন্দাদের উদ্দেশে জারা লেখেন, 'আমি আপনাদের এবং দেশের মানুষকে কথা দিয়েছিলাম যে আপনাদের জন্য এবং নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার জন্য লড়ব। পরিস্থিতি যা-ই হোক, আমি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে বদ্ধপরিকর।'
তিনি আরও লেখেন, 'একটা দলের প্রার্থী হলে সেই দলের স্থানীয় অফিস থাকে, সুসংগঠিত কর্মী বাহিনী থাকে। সরকার ও প্রশাসনের সাথে নিরাপত্তা বা অন্যান্য বিষয়ে আপত্তি ও শঙ্কা নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকে। তবে আমি যেহেতু কোন দলের সাথে থাকছি না, তাই আমার সে সব কিছুই থাকবে না।'
ফেসবুক পোস্টে জারা উল্লেখ করেন, প্রার্থিতা বৈধ করতে তার ঢাকা-৯ আসনের ৪ হাজার ৬৯৩ জন ভোটারের স্বাক্ষর প্রয়োজন। আজ থেকে তিনি এই স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করবেন এবং এ জন্য স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা চেয়েছেন।
পদত্যাগের আগে নির্বাচনের খরচের জন্য তাসনিম জারা 'ক্রাউডফন্ডিং'-এর মাধ্যমে ৩০ ঘণ্টার কম সময়ে ৪৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। এনসিপি থেকে পদত্যাগের পর তিনি সেই টাকা ফেরত দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদিব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জারা আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বার্তা দিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দল কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই তিনি ফেসবুকে বিষয়টি প্রকাশ্যে পোস্ট করেন।'
নেতৃত্বের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠক ও হোয়াটসঅ্যাপ বিতর্ক
যদিও দলীয় নেতৃত্ব শুরুতে জোটের বিষয়টি স্বীকার করেনি, তবে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সূত্র নিশ্চিত করেছে যে একাধিক বৈঠকের পর জামায়াত-এনসিপি জোট বা আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। এখন কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা।
সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে সম্ভাব্য জোট নিয়ে আলোচনায় অসন্তোষ থেকে জ্যেষ্ঠ নেতারা জামায়াতের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেন। নির্বাচনী বাস্তবতা বিবেচনায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনসহ শীর্ষ নেতারা জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখাও করেন।
গত ১৯ ডিসেম্বর এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিষয়টি প্রকাশ পায় এবং পরে একটি স্ক্রিনশট ফেসবুকে ফাঁস হয়। এর জেরে ২০৮ সদস্যের গ্রুপটি ভেঙে দেওয়া হয়।
গত সপ্তাহে জোট নিয়ে একাধিক নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দলের আহ্বায়ক, সদস্যসচিব ও শীর্ষ পাঁচ নেতাসহ কমিটির বড় একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা ও আসন ভাগাভাগির পক্ষে মত দেন। তবে পাঁচজন নারী নেতাসহ প্রায় ৩০ জন সদস্য প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট নিয়ে দলের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিষয়টি শীর্ষ নেতাদের জানানো হয়েছে এবং আলোচনা চলছে।'
বিরোধিতাকারী নেতারা বলছেন, এনসিপি গত দুই মাস ধরে সংস্কারমুখী রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। অল্প কিছু আসন পেলেও দলের উচিত ছিল স্বতন্ত্র পরিচয় ধরে রাখতে এককভাবে নির্বাচন করা।
এনসিপির এই সিদ্ধান্তে 'গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট'-এর শরিকদের মধ্যেও ফাটল ধরেছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক শিবির নেতা মজিবুর রহমান মনজু জামায়াতের সঙ্গে জোটে রাজি থাকলেও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান হাসনাত কাইয়ুম জামায়াত, বিএনপি বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটের বিরোধিতা করেছেন।
শুক্রবার তোপখানা রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, এনসিপি ও এবি পার্টির জোটের বিষয়টি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। জোটের নামের সঙ্গে 'গণতান্ত্রিক' শব্দের উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াত একটি অগণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠিত হয়েছিল জামায়াত ও বিএনপির বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরির জন্য।
এদিকে জামায়াতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা স্পষ্ট করেছেন, এটি কোনো জোট নয়। আমরা দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আসনভিত্তিক সমঝোতা নিয়ে আলোচনা করছি। এনসিপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো জোটের আলোচনা নেই।
অন্যদিকে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন গত রাতে এক বিবৃতিতে নির্বাচনী জোট নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সর্বদলীয় সংলাপের সময় সংস্কার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য দলের মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু এনসিপি, জামায়াত ও অন্যদের মধ্যে মূল বিষয়গুলোতে স্বাভাবিক মিল পাওয়া গেছে। ফলে রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই জোট বা সমঝোতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে দল।


Comments