ভিভিআইপি এডিস, বাধ্যগত প্রশাসন ও আমরা সামান্য প্রজা

এই শহর, এই জনপদ, এই বঙ্গভূমি এখন ডেঙ্গুময়। আক্ষরিক অর্থে এখন রাজত্ব চলছে আমাদের এডিস মশা-মশাইদের। আমাদের ভাগ্য যেন তাদের হাতেই। তাদের দয়া হলে আমরা হাসপাতালে যাব, না হলে সুস্থ থাকব, অথবা পটল তুলব!
আমাদের নাগরিক জীবনের ব্যর্থতা, প্রশাসনিক শ্লথতা, পরিবেশ-উদাসীনতা—সবকিছুর যোগফলেই তারা এখন সবচেয়ে দৃশ্যমান। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো লেখক যদি এখন 'বাংলাদেশ' নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসেন, মশা চরিত্রটি হবে প্রধান; আর উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স হবে সিটি করপোরেশনের ফগিং মেশিনের সামনে মশার বিজয়ী হাসি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করুণ রসভান্ডার থেকে জানা যায়, এ বছর ৫৭ হাজারেরও বেশি নাগরিককে মশা-মশাইয়ের রাজকীয় উষ্ণতা গ্রহণ করতে হয়েছে। আর ২৪২ জন তো সরাসরি মোক্ষলাভ করে চলে গেছেন ওপারে।
এডিসের রাজত্বে আমরা সামান্য প্রজা
এডিস মশা এখন আর স্রেফ পতঙ্গ নয়, সে এই নগরীর একজন ভিভিআইপি! কারণ সে জানে, তার জন্মস্থান কেউ স্পর্শ করবে না। বাড়ির ছাদের জমা পানি, ফুলের টবের নিচে ফেলে রাখা কফি মগ বা নির্মাণাধীন ভবনের জলজ আধার—সবই তার জন্য নিরাপদ প্রজনন কেন্দ্র। কারও সাধ্য নেই তার অভয়াশ্রমে হাত লাগায়!
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী মশাদের নিয়ে কিছু লিখেছেন কিনা জানা নেই। তবে তার ভ্রমণ কাহিনীর স্টাইলে বলা যায়, 'ডেঙ্গু তো আর শুধু শহরে নেই, এখন বরিশাল বিভাগে ১৪ হাজারেরও বেশি আক্রান্ত! বরগুনায়ও মশার উপদ্রব। তাই মশাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, এত কীসের তাড়া মশা-মশাই? দূর থেকে তো শহরই চেনা যায়, গ্রাম চেনার এত কী প্রয়োজন ছিল?'
মশা ও প্রশাসনের ভালোবাসার গল্প
আসলে মশাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষটা আমাদের, যারা বছরের পর বছর মশা নিয়ন্ত্রণের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলেছি, কিন্তু সুফল পাচ্ছি না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশক ক্রয়ে সুশাসন বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কোনোটাই অনুসরণ করা হয়নি।
এর মানে হলো, আমরা মশাদের এমন ইনজেকশন দিচ্ছি, যা তাদের শুধু ইমিউনিটি বাড়াচ্ছে, মারছে না। যেন প্রশাসনের গোপন লক্ষ্য, 'মশাদের যেন কোনো কষ্ট না হয়, তারা সুস্থ থাকুক, প্রজনন বাড়ুক।'
এডিস মশার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই প্রশাসন অনেকটা অন্ধ ও বধির—কিছুই দেখে না। আবার বছর বছর যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, তা কানেও ঢোকে না। তারা লুটপাটে লুটোপুটি খেতেই ব্যস্ত!
ধোঁয়ার হালকা ছোঁয়া
এখন আর আগের মতো 'ফগিং অভিযান শুরু হবে' বলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় না। যদি কখনো হয়ও, হয়তো বিজ্ঞপ্তিটা এমন হবে, 'আগামীকাল সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকার সব এলাকায় ফগিং কার্যক্রম চলবে, তবে শর্তসাপেক্ষে—বৃষ্টি না হলে, বিদ্যুৎ থাকলে, মেশিন চালু হলে, ড্রাইভার হাজির থাকলে।'
বিজ্ঞপ্তির নিচে মশাদের প্রতি একটুখানি সৌজন্যবার্তা জুড়ে দেওয়া হবে, 'বি.দ্র. প্রিয় এডিস মহাশয়গণ, এ সময় একটু ধৈর্য ধরবেন দয়া করে। আমরা আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে চাই না, কেবল পরিবেশে ধোঁয়ার হালকা ছোঁয়া দিতে চাই। তবে আপনারা যদি একটু সহানুভূতিশীল হন, আমরা পরের বার ধোঁয়াটার সুগন্ধে লেমন গ্রাস মিশিয়ে দেবো। আপনাদের সেবায় আমরা সদা নিয়োজিত!'
কীটতত্ত্ববিদহীন নগর ও অন্ধকারে ঢিল
এই প্রশাসন ব্যবস্থাটা আসলে মশাদের প্রতি এক গভীর দার্শনিক শ্রদ্ধার প্রতীক। সারা দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে মাত্র একটিতে কীটতত্ত্ববিদ আছেন। অন্যদিকে সারাদেশে ৩৩টি পদের মধ্যে ১৮টিই ফাঁকা রয়েছে। (দ্য ডেইলি স্টার, ২ অক্টোবর ২০২৫)
অর্থাৎ অন্য ১১টি সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বা অধিদপ্তর আলোর খোঁজে অন্ধকারে ঘুরছে, কিংবা বলা যায় 'অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছে'। এ আসলে মশা-মহাশয়ের সম্মানে আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে! হয়তো খুঁজলে সেসব ফাঁকা আসনে (চেয়ার যদি থাকে) মশার অবস্থান নিশ্চিত পাওয়া যাবে।
এদের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঠিক প্রেমিকের মন ভোলানোর চেষ্টার মতো—জোর আছে, ফল নেই। কেবলই রাসায়নিকের গন্ধ আর অর্থের শ্রাদ্ধ।
জলবায়ুর উপহার ও ভাইরাসের ফ্যাশন
জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে শুধু উষ্ণতা আর অনিয়মিত বৃষ্টি পাচ্ছি। এক সময় জুন-জুলাই ছিল মশার পিকটাইম, এখন তা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রকৃতি যেন মশাদের হাতে বাড়তি ছুটি ধরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু মশারাও থেমে নেই। তারাও কি কম ফ্যাশন সচেতন! তাদের সেরোটাইপও প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। এই ভাইরাসগুলো মানুষের ইমিউন সিস্টেম নিয়ে কী নিখুঁত 'খেলা'ই না খেলছে।
মশাদের এই বৈজ্ঞানিক কূটকৌশল দেখে কবি জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন—
'হাজার দিন ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি ডেঙ্গু আর এডিসের সঙ্গে,
আর চলিতেছি আজো- তবু এই পৃথিবীর বিষাক্ত রাতের আলোয়
জমানো জলের ঘ্রাণ এডিসরে দিয়েছে সুদিন,
তাই দ্বিতীয়বার কামড়েই সে আনে শক,
আর আমরা ঘুমাই, স্রেফ ঘুমাই!'
রিয়েলিটি শো ও বিশেষজ্ঞ কমিটি
প্রতিবারই গঠিত হয় 'বিশেষজ্ঞ কমিটি', যারা টেবিলের চারপাশে বসে মশার জীবনচক্র নিয়ে তর্ক করেন। কোনোদিন হয়তো টিভিতে রিয়েলিটি শো হবে 'সিটি করপোরেশন প্রেজেন্টস: কে হবে এডিস হান্টার!' দর্শক ভোটে বিজয়ী পাবেন এক বোতল কীটনাশক ও একটি ভাঙা ফগিং মেশিন।
মৃত্যুফাঁদের সতর্ক সংকেত: হাসপাতালে ভর্তি হোন
হাসতে চাইলেও হাসা যায় না। কারণ, এই মশার কাছে মানুষের জীবন তুচ্ছ! জীবন ঝরে পড়ছে। ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহতা নিয়ে আমরা রসিকতা করতে পারি, কিন্তু সংকটকাল শুরু হলে রসিকতা স্তব্ধ হয়ে যায়।
জ্বর ছাড়ার পরের ২৮-৪৮ ঘণ্টা হলো সেই মরণফাঁদ।
মশা মারা সম্ভব হোক বা না হোক, নিজেকে বাঁচানোটাই আসল যুদ্ধ। জ্বর হলেই পরীক্ষা করাতে ভুলবেন না। আর এই লক্ষণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকুন—তীব্র পেটে ব্যথা, টানা বমি, নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত যাওয়া, বিভ্রান্তি বা তন্দ্রা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়া।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে ঘরে বসে থাকবেন না, কোনোভাবেই দেরি করবেন না, সোজা হাসপাতাল যান। রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, বা প্রতিবেশীর কাঁধে- যেভাবেই হোক, যান!
শেষ কথা
শেষে আবার ফিরি সেই শুরুর কথায়। এই ডেঙ্গু সংকট আসলে আমাদের আয়না, যাতে আমাদের প্রশাসনিক দুর্বলতা, জলবায়ু উপেক্ষা ও নাগরিক উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।
আমরা যতক্ষণ না দায়িত্বশীল হব, ততক্ষণ মহামহিম এডিস মশা-মশাই তাদের রাজত্ব চালিয়ে যাবেন।
মশাকে ঘৃণা করে নয়, মশাকে ভয় পেয়েই হয়তো একদিন আমরা শোধরাবো। ততদিনের জন্য—মশারি টানান, সচেতন থাকুন, আর নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশে পানি জমতে দিবেন না। পানি জমলে মশা কিন্তু জম হয়ে ফিরবে।
আর হয়তো ইতিহাস বইতে তখন লেখা থাকবে, 'বাংলাদেশ ছিল এক সাহসী জাতি, যারা সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, শুধু এডিস মশাকে ছাড়া।'
তানজিল রিমন; সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক
Comments