নিরাপদ ও সচ্ছল জীবন পেতে প্রবাসীদের জানতে হবে ‘মানি ম্যানেজমেন্ট’

প্রবাসী আয়

প্রবাসীদের হাতে কিছু টাকা থাকে, কিন্তু এই টাকার সঠিক ব্যবহার করতে না পারায় তারা পরবর্তীতে অর্থকষ্ট বা নানারকম হতাশায় পড়েন।

প্রবাসীরা বাংলাদেশের অক্সিজেন। কিন্তু তাদের সেভাবে কোনো মূল্যায়ন নেই দেশে বা বিদেশি দূতাবাসে। দেশের বিমানবন্দরে ও বিদেশি দূতাবাসে প্রবাসীদেরকে 'স্যার' ডেকে সর্বোচ্চ সেবা ও ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া উচিত।

দেশের সবাই জানে প্রবাসীদেরকে কিছু বিষয়ে তিন থেকে ছয় মাসের ট্রেনিং দিয়ে বিদেশে পাঠালে তাদের আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব। এতে দেশের রেমিট্যান্সও দ্বিগুণ হারে বাড়ে। কিন্তু কেউ এই দায়িত্ব নিচ্ছে না।

তাই আপনার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। কিছু দায়িত্ব 'নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন' নিয়েছে আপনাদের জন্য। প্রায় আট বছর ধরে আমরা প্রবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা তৈরিতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি। কিছু দক্ষতা শিখে তারপর বিদেশে যান।  

প্রবাসীরা কয়েকবছর বিদেশে থেকে কিছু টাকা নিয়ে দেশে আসেন, বাড়ি বানান, তারপর বিয়ে করে আবার বিদেশে চলে যান। কিছুদিন পর সন্তান হয়, কিন্তু তারা দেখতে পারেন না। সন্তান বড় হয়ে বাবাকে ছুঁতে পারে না, তার গায়ের গন্ধ নিতে পারে না। প্রবাসী বাবা তার সন্তানকে অনুশাসন দিতে পারেন না। অনেক সময় সন্তান মানুষ হয় না বাবার দেখভাল করতে না পারার কারণে। তখন সব কষ্ট, সব অর্জন বৃথা হয়ে যায়।

ঈদ যায়, নানা উৎসব যায়, প্রবাসীরা দেশে আসতে পারেন না। মা-বাবা বা ভাইবোন মারা যায়– আসতে পারেন না, শেষ দেখা দেখতে পারেন না, মাটিও দিতে পারেন না। শুধু আত্মত্যাগ আর আত্মত্যাগ তাদের। পরিবারকে একটু ভালো রাখার জন্য প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।

আপনারা যারা ভবিষ্যতে বিদেশে (মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা) কাজের জন্য যেতে চান, তার আগেই অবশ্যই আমাদের ৯০ দিনের কোর্সটা করে যাবেন। এটা বিনামূল্যে শিখতে পারেন। এতে করে বেশি বেতনের ভালো চাকরি পাবেন এবং দেশের রেমিট্যান্স আরও বাড়বে।

এই কোর্সে যেসব বিষয় শেখানো হয়, সেগুলোর মধ্যে আছে— কথা বলার জড়তা কাটানো, ইংরেজিসহ আরও অন্যান্য দেশের ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে পারা, লিডারশিপ, কমিউনিকেশন ও মানি ম্যানেজমেন্ট।  

এছাড়া রয়েছে সেলস ও মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ, যা আমাদের ৯০ দিনের সেশনে বিনামূ্ল্যে নিতে পারবেন। আর সেইসঙ্গে যে বিষয়ে কাজ করতে যাচ্ছেন, সেই বিষয়ে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ।

বিদেশে যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেলে আপনার বেতন দ্বিগুণ হবে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— হোটেল ম্যানেজমেন্ট, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, কেটারিং, কুকিং ও সেফ, ক্লিনিং, ড্রাইভিং, রোড কনস্ট্রাকশন, নার্সিং, ইলেকট্রিক্যাল ইলেকট্রনিক্স মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মোবাইল টেকনিশিয়ান, প্লাম্বিং, গাড়ির গ্যারেজের টেকনিক্যাল কাজ, এসি টেকনিশিয়ান, ওয়েল্ডিং, রাজমিস্ত্রী, কার্পেন্টার, পেইন্টার, জিপসাম ডেকোর, ইনটেরিয়র ডিজাইনার এবং অ্যালুমিনিয়ামের কাজ।

যারা এই মুহূর্তে প্রবাসে কর্মরত আছেন, তারাও এই বিষয়গুলো শিখে ফেলতে পারেন। এতে আপনার আয় দ্বিগুণ হবে।

প্রায় এক কোটি প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। কিন্তু তারা এসব দেশে ১৫-২০ বছর থাকলেও কোনোদিন গ্রিন কার্ড পাবেন না। আবার দেশে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু দেশে এলে তারা কী করবেন বা কীভাবে করবেন?

প্রবাসীরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ ও মানবিক। এটার সুযোগ নেয় অনেকে। তারা কিছু ভুল করে বসেন। যেমন— পরিবারকে খুশি করার জন্য নিজে না খেয়ে বা সঞ্চয় না করে আয়ের বেশিরভাগ অংশ দেশে পরিবারকে দিয়ে দেন। পরিবারের জন্য অবশ্যই টাকা পাঠাবেন, কিন্তু আপনার সঞ্চয়ও রাখতে হবে।

অনেকে আবার কিছু টাকা জমলে শুরুতেই একটা বাড়ি বা দালান করে ফেলেন। আমি অনেক প্রবাসী পরিবারকে দেখেছি, জমানো সব টাকা দিয়ে একটা বাড়ি করে ফেলেন। পরে দেশে ১০-১৫ বছর পর ফিরে ঠিকমতো ঘরের বাজারসদাই করতে পারেন না। শুধু মানি ম্যানেজমেন্ট না জানার কারণে।

প্রবাসীরা আরেকটা ভুল করেন, অন্যের নামে টাকা পাঠান। মামা, চাচা, কোনো আত্মীয় বা ভাইয়ের নামে টাকা না পাঠিয়ে বাবা-মা বা স্ত্রীর নামে পাঠাবেন। দেশে নিজের নামে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করবেন।

সব টাকা এক ব্যাংকে রাখবেন না। ঝুঁকিপূর্ণ কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করবেন না।

কেউ বিপদের কথা বললেই প্রবাসীরা টাকা ধার দিয়ে দেন। এভাবে উপকার করতে গিয়ে তারা সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেন। পারলে কারো বিপদে একেবারে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু দিয়ে দেন, যেটা আর কখনো ফেরত চাইতে হবে না।

অনেক প্রবাসী নিজের নামে না কিনে ভাই, স্ত্রী বা কোনো আত্মীয়ের নামে জমি কেনেন। এ নিয়ে অনেকেই পরে ভয়াবহ বিপদে পড়েন। এটা করা যাবে না। জমি নিজের নামেই কিনবেন। টাকা জমান। যখন জমি কেনার টাকা হবে, তখন দেশে গিয়ে নিজের নামে কিনবেন।

ব্যবসা করার জন্য অনেক প্রবাসী অন্যের হাতে টাকা তুলে দেন। এটা মারাত্মক ভুল। পারলে নিজে বা নিজের পরিবারের কাউকে নিয়ে একা কিছু করেন। শুরুতেই পার্টনারশিপে যাবেন না। সেখানেই টাকা দেবেন, যেখানে আপনার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। টাকা জমা হবে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, কারও পকেটে না।

ব্যাপক পরিশ্রম করতে গিয়ে নিজের শরীরের কথা অনেকে ভুলে যান। নিজের শরীরের যত্ন নেন না। আপনার সব অর্জন শেষ হয়ে যাবে যদি আপনি সুস্থ না থাকেন।

পারিবারিক বা সামাজিক চাপে বা লোক দেখাতে প্রবাসীদের কেউ কেউ অনেক খরচ করেন বা বিয়েতে অনেক লোক খাওয়ান। এসব করবেন না। আপনার মন যা বলে বা আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী করবেন। লোকে আপনার বাবা-মায়ের ওষুধের টাকা দেবে না, দুঃসময়ে আপনার বাসার বাজার করে দেবে না। তাই লোকে কী বলবে, শোনার দরকার নাই।

ব্যস্ততার জন্য নিজের ছেলেমেয়ে প্রতিদিন কী করছে, খোঁজখবর রাখেন না অনেকে। একসময় দেখা যায় সন্তান বিপথে চলে গেছে। প্রতিদিন সন্তানদের সাথে ভিডিওকলে পাঁচ মিনিট হলেও কথা বলবেন। তারা আজ সারাদিন কী করেছে, কী পড়েছে—এগুলো নিয়ে বন্ধুর মতো আলাপ করবেন। আপনি যে তাদের জন্য এত কষ্ট করছেন, ত্যাগ স্বীকার করছেন— এটা তাদের বোঝাবেন, স্বপ্ন দেখাবেন। 

নতুন কিছু শেখার চেষ্টা না করা বা দক্ষতা না বাড়ানোটাও প্রবাসীদের একটা বড় ভুল। কেউ কেউ ভাবেন, 'এখানকার কাজটাই যথেষ্ট।' কিন্তু ভাষা, স্কিল বা কোর্স শেখার চেষ্টা না করলে উন্নতির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।

প্রবাসে যাওয়ার পর ১০-১৫ বছরের মধ্যে প্রবাসীদের উচিত মানি ম্যানেজমেন্ট শেখা। এক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দেই।

১. সাতটা ডিপিএস করবেন এক হাজার টাকা করে। ৫, ৫, ৭, ৯, ১০, ১২, ১৪ বছর মেয়াদি। ৫০০ টাকা দিয়ে হলেও শুরু করেন কোনো পুরনো ব্যাংকে।

  • বাড়ি করার জন্য ১৪ বছর মেয়াদি
  • জমি কেনার জন্য ১০ বছর মেয়াদি
  • গাড়ি বা কোনো সম্পদ কেনার জন্য ১২ বছর মেয়াদি
  • বিয়ে করার জন্য ৫ বছর মেয়াদি
  • বাচ্চার লেখাপড়ার জন্য ৭ বছর মেয়াদি
  • বাবা-মাকে হজ করানোর জন্য ৯ বছর মেয়াদি
  • বিপদ-আপদ বা চিকিৎসার জন্য বা জরুরি ফান্ডের জন্য ৫ বছর মেয়াদি

এই টাকা কখনো ভাঙবেন না। ধরে নিন এটা আপনার প্রতি মাসে খরচ হয়ে গেছে।

২. যতবার বেতন বাড়বে, ততবার নতুন এক বা দুটো করে ডিপিএস করবেন। যেমন: প্রতি বছর শেষে আপনার বেতন যদি তিন হাজার টাকা বাড়ে, দুই হাজার টাকা দিয়ে আরও দুটো ডিপিএস করবেন। আর এক হাজার টাকা নিজের বা পরিবারের জন্য খরচ করবেন।

৩. পরিবারের জন্য হয়তো মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা পাঠান। এখন থেকে এক হাজার টাকা কম পাঠাবেন, বলবেন— কষ্ট করে চলো সবাই। ওই টাকা দিয়ে আরেকটা ডিপিএস করবেন।

৪. এভাবে প্রতিবছর এক-দুইটা করে নতুন ডিপিএস করতে থাকলে পাঁচ-সাত বছর পরে আপনার ডিপিএসের সংখ্যা হবে ১২-১৫টা। সেগুলো প্রতিবছর দুই-তিনটা করে ম্যাচিউরড হতে থাকবে এবং আপনার হাতে নতুন বিনিয়োগ বা খরচ করার জন্য সবসময় টাকা থাকবে। 

৫. দেশে নিজের নামে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করবেন। পরিবারের জন্য খরচের টাকা পাঠিয়ে বাকি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে রাখবেন। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাকা ডিপিএসে চলে যাবে। অন্য কারো অ্যাকাউন্টে টাকা রাখবেন না। ৫০ হাজার টাকা জমলে একটা করে এফডিআর করবেন ডিপিএসের পাশাপাশি। এভাবে একটার পর একটা এফডিআর করবেন। 

৬. শুধু একটা কাজ বা একটা চাকরি করার জন্য আপনার জন্ম হয়নি। আমাদের ফাউন্ডেশন থেকে বিনামূল্যে ব্যবসা ও কিছু দক্ষতা শিখে পার্টটাইম কোনো কাজ বা ব্যবসা করার চেষ্টা করুন। সাহস করে শুরু করে দিন। 

৭. দেশে আসলে কী করবেন, তা নিয়ে যেন আর ভাবতে না হয়। দেশে আসার আগেই ব্যবসাটা ছোট করে শুরু করে দিন। কারও হাতে ব্যবসা করার জন্য টাকা তুলে দেবেন না। ব্যবসায় নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখুন। 

৮. এক নম্বরের ডিপিএসগুলো ম্যাচিউরড হলে জমি কিনবেন, বাড়ি করবেন, গাড়ি করবেন, ব্যবসা করবেন।

৯. এমন কিছুতে বিনিয়োগ করবেন, যেন ব্যবসা ভালো না চললেও আপনার ফিক্সড কিছু ইনকাম প্রতি মাসে নিশ্চিত থাকে। যেমন— দোকান কিংবা বাড়ি এমনভাবে করা, যেন দুই-তিনটা ফ্লোর ভাড়া দেওয়া যায় বা কোনো কমার্শিয়াল স্পেস করা ইত্যাদি। এসব নিজের নামে কিনবেন, যেন মাসের খরচ চালাতে আপনার কোনো সমস্যা না হয়। এটা আপনার ব্যাকআপ প্ল্যান। 

এসব করলে আপনি ভালো থাকবেন, আপনার পরিবারও নিরাপদে থাকবে। দেশে ফিরলেও আপনি আর্থিক সংকটে পড়বেন না। মানি ম্যানেজমেন্ট জানলে আপনি আপনার টাকাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।


ইকবাল বাহার, প্রেসিডেন্ট ও ফাউন্ডার, নিজের বলার মতো একটা গল্প ফাউন্ডেশন

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia’s janaza held

The namaz-e-janaza of BNP Chairperson Khaleda Zia was held at the South Plaza of the Jatiya Sangsad Bhaban today

6h ago