অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে হঠাৎ কেন এত সরব দলগুলো?

প্রতীকী ছবি

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত ২১ অক্টোবর বৈঠক করেছে বিএনপি। ঠিক তার পরদিন ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আলাদা করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকের কারণ—তিনটি দলই মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার 'পক্ষপাতদুষ্ট' হয়ে পড়েছে।

উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো নির্দিষ্ট দলকে সহযোগিতা করছেন; প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় লোকজন ঢুকে পড়েছে—এমন নানা অভিযোগ তুলছে দলগুলো। ফলে, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারও।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সরকারকে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বড় ধরনের রদবদল করতেও বলা হচ্ছে।

সার্বিকভাবে সমসাময়িক দেশের রাজনীতি বেশকিছু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে অংশ নেওয়া সবপক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে যে সরকার গঠন করা হলো, সেই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এত প্রশ্ন কেন উঠছে? হঠাৎ কী এমন হলো যে দলগুলো এক বছর পর এসে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সরব হয়ে উঠল? এর পেছনে আসলে কোন ফ্যাক্টরগুলো কাজ করছে? কেন দলগুলো পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে? 'জনগণ'-এর দলগুলো কি জনস্বার্থে এই অবস্থান নিচ্ছে, নাকি যেকোনো মূল্যে নির্বাচনের মাঠে সুবিধা আদায় করাটাই প্রধান?

২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছিল অভিযোগকারী এই দলগুলো। বলেছিল, সব অবস্থাতেই সহযোগিতা করবে। কিন্তু, এক বছর পার হতে সেই সুরটা যেন অনেকটাই বদলে যাচ্ছে।

জুলাই গণঅভ্যুথ্থানের সামনের সারির ছাত্রনেতাদের সমর্থনেই ক্ষমতায় এসেছিল অন্তর্বর্তী সরকার, যারা পরে এনসিপি গঠন করে। সরকারে নবগঠিত এই দলটির কর্মী ও সমর্থক কয়েকজন উপদেষ্টা হিসেবেও ছিলেন। উপদেষ্টাদের অনেকের নামে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা আদর্শের প্রতি দুর্বলতার কথাও নানাসময়ে প্রকাশ্যে এসেছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও এখনো সেই 'পক্ষপাতদুষ্ট' উপদেষ্টারা সরকারে রয়েছেন বলেই মূলত আপত্তি তুলছে দলগুলো।

প্রধান উপদেষ্টা বহুবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদেরকে তার 'নিয়োগকর্তা' বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ, সেই সরকারই ক্ষমতায় থাকার পরও এনসিপি তাদের 'নিজেদের' সরকারকে আর নিরপেক্ষ মনে করছে না।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে পুলিশ ও প্রশাসন নিজেদের মতো ভাগ-বাটোয়ারা শুরু করছে। আর উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও তাদেরকে সহায়তা করা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে এনসিপির নেতারা এ-ও বলেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে উপদেষ্টারা 'সেফ এক্সিটে'র কথা ভাবছেন।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না বলেও অভিযোগ এনসিপির। এখন পর্যন্ত শাপলা প্রতীক বরাদ্দ না পাওয়ায় কমিশনের ওপর দলটি ক্ষুব্ধ। প্রতীকের কারণে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের বিষয়টিও ঝুলে আছে।

শুরু থেকে জামায়াতের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল তরুণদের দল এনসিপির। কিন্তু এখন তারা বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতেরও কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছে। জুলাই সনদে সই করা নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে তাদের এককালের ঐক্যে বেশ ভালোভাবেই ফাটল ধরেছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

যে জুলাই সনদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব ছিল এনসিপি, সেই দলটি 'আইনি ভিত্তি এখনও ঠিক হয়নি' বলে ১৭ অক্টোবর সনদে স্বাক্ষরই করেনি।

এনসিপির 'বন্ধু' জামায়াত একদিন আগেও একই অভিযোগ তুলে স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা জানালেও পরদিন স্বাক্ষর করে। ফুঁসে ওঠে এনসিপি। অল্পস্বল্প বিরোধ এই ঘটনায় মুহূর্তেই তীব্র হয়ে ওঠে।

এ ঘটনার পর এনসিপি নেতা নাহিদ জামায়াতের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির দাবিতে চলা আন্দোলনকে 'রাজনৈতিক প্রতারণা' আখ্যা দেন। প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, 'জন্ম নিয়েই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ো না।'

এদিকে গত ২১ অক্টোবরের বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে গঠনের কথা বলেছে বিএনপি। সেইসঙ্গে সরকারের মধ্যে যদি কোনো দলীয় লোক থাকে, তাহলে তাদের অপসারণ করতেও তাগিদ দিয়েছে।

এই বৈঠকের আগেও বিএনপি কয়েকজন উপদেষ্টার বক্তব্য, প্রশাসনে রদবদল বা পদায়নে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছিল। গত সপ্তাহে বিএনপি অভিযোগ তুলেছিল, উপদেষ্টাদের কয়েকজন জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন।

বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীও কয়েকজন উপদেষ্টা ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা মনে করছে, উপদেষ্টাদের মধ্যে কয়েকজন একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দিচ্ছে। নাম না বললেও এর আগে দলটির অনেক নেতাই তাদের বক্তব্যে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।

জামায়াত ওই বৈঠকে অভিযোগ করেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকই বিএনপির। তাই প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনে রদবদল করতে হবে।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, ত্রিমুখী এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আসছে মূলত দলীয় স্বার্থ, ক্ষমতা ও পদ ভাগাভাগি এবং আসন্ন নির্বাচনে কে কতটা সুবিধা করতে নিতে পারবে সেই সমীকরণ থেকে।

একেবারে প্রকাশ্যে না আসলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অফিস-আদালতগুলো থেকে 'ফ্যাস্টিস্টের লোক হটিয়ে' নিজেদের লোক বসাতে সচেষ্ট হয় বড় রাজনৈতিক দলগুলো—বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত। এখন তারাই প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে!

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দেশব্যাপী মব ভায়োলেন্স ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনমন হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টাও স্পষ্ট এবং অনেকক্ষেত্রে ফায়দা মিলেছেও। পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বার বার। আগামী নির্বাচনে মব ভায়োলেন্স ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে কোনো পক্ষকে চাপে ফেলা হবে কিনা- এই শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। তারওপর ডিসি-এসপি থেকে শুরু করে অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোতে ব্যাপক হারে দলীয় পদায়নের যে অভিযোগ আসছে, তা সত্যি হলে গোটা ব্যবস্থার নিরেপেক্ষতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। তারা যেহেতু নির্বাচনের সময় মাঠে থাকবে, তাই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে।

আবার এমনও হতে পারে, নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলো নিজেদের আখের গোছানোর পরিকল্পনায় আছে। তারা হয়তো চাইছে, নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে এমন সব জায়গায় নিজের লোক কম থাকলেও চলবে, কিন্তু বিপক্ষ দলের লোকজন যেন বেশি না হয়ে যায়। অন্যথায় নির্বাচনে 'সুযোগ-সুবিধা'র প্রশ্নে বিপক্ষ দল এগিয়ে থাকবে। হতে পারে, সম্ভাবনাময় মসনদটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Challenges in Policing 1: Police stations buckling under budget strain

The government also supplies police stations with some of the items they request each month, but only a portion of the demand is met.

11h ago