সৌম্যকে সৌম্যের মতন খেলতে দেওয়ার সময় এসেছে
একটি হাতি, একটি মাছ, আর একটি বানরকে বলা হচ্ছে গাছে উঠতে। আপনি হয়ত সেই ছবিটা দেখেছেন—যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থায় সবাইকে একই পরীক্ষায় মাপার চেষ্টা করে, যার ফলে কেউ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আবার কেউ নিজেকে অযোগ্য মনে করে। এটা বোঝাতে ছবিটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। তবে এই ছবির বার্তা কেবল শ্রেণীকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। খেলাধুলাতেও আমরা প্রায়ই একই মানদণ্ডে সবাইকে বিচার করি, উপেক্ষা করি সেই বাইরের প্রভাবগুলোকে, যা একজন খেলোয়াড়ের আসল প্রভাবকে নির্ধারণ করে।
একজন প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ হয়তো নিজের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে মানদণ্ডে মেলাতে গিয়ে; কেউ কেউ পরিসংখ্যান বাড়িয়ে নিজেদের আলাদা করে তুলতে পারে; আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি—খেলাটি হারাতে পারে সেই বিশেষ প্রতিভাবানদের, যারা খেলাটাতে অন্যরকম সৌন্দর্য ও আকর্ষণ যোগ করে।
ক্রিকেট ও প্রথার অস্বস্তিকর সম্পর্ক
ক্রিকেট শুরু থেকেই প্রথাগত নিয়মের শিকলে বাঁধা ছিল। ১৮০০ সালের ব্রিটিশ অবসর বিনোদন সময়ের সঙ্গে বদলে হয়ে গেছে এক গতিশীল খেলায়, কিন্তু এখনও এটি প্রথা ও ধারা মেনে চলা একটি খেলা—যা পুরোনো ধ্যান-ধারনাকে ছাড়তে খুব কষ্ট পায়।
অস্ট্রেলিয়ান মহাতারকা ডন ব্র্যাডম্যান প্রথম আবির্ভূত হন, যেসব ব্রিটিশ অভিজাত খেলাটা চালাতেন, তারা হতভম্ব হয়ে যান। কারণ নির্দিষ্ট লাইন-লেংথে প্রথাগত শট না খেলে তিনি নিজস্বভাবে শট খেলতেন—বাউন্সার এলে হুক না করে পাশ কাটিয়ে কাট মারতেন, আবার শর্ট-পিচ বল পেলে কাট না করে টানতেন।
সেই সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এখন ইংলিশ ব্যাটাররা ৯০ মাইল গতির বল প্রথম সেশনেই রিভার্স-সুইপ করছে অ্যাশেজ টেস্টে। খেলা এগিয়ে গেছে, তবে সব জায়গায় নয়—উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক বাংলাদেশকে।
এখনও এখানে যদি কোন কিশোর সাহস করে 'অন দ্য আপ' মারতে চায়, তাহলে স্থানীয় কোচেরা বকাবকি করেন। বোলারদের ভিন্ন রকম অ্যাকশন দেখলেই বলা হয় 'অ্যাকশন ঠিক করো'; আর ব্যাটারদের বিচার হয় কেবল এক মানদণ্ডে—কত রান করেছে।
অবশ্যই রান গুরুত্বপূর্ণ—যেমন পানি জীবনের জন্য অপরিহার্য—কিন্তু শুধুমাত্র সংখ্যার দিকে তাকিয়ে কখন, কীভাবে, কার বিপক্ষে রান এসেছে সেটা উপেক্ষা করা ক্রিকেট বোঝার এক অগভীর উপায়।
সৌম্য সরকার: স্বভাবজাত বিদ্রোহী
দেশীয় ক্রিকেট কাঠামো এই সমস্যাটাকেই আরও গভীর করে। যারা জাতীয় দলে আসে, তাদের প্রায় সবাই ক্লাবে টপ অর্ডারে ব্যাট করে, কারণ যত বেশি সময় ব্যাট করবে তত বেশি রান হবে, আর যত বেশি রান হবে তত বেশি স্বীকৃতি মিলবে।
যে দেশে অপ্রচলিত কিছু দেখলেই বাতিল করে দেওয়া হয়, সেখানে সৌম্য সরকারের মতো একজন খেলোয়াড়ের এত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা সত্যিই বিস্ময়কর।
সৌম্যের ব্যাটিং ভঙ্গি থেকে শুরু করে তার সুশোভিত স্ট্রোক—সবকিছুতেই রয়েছে সৌন্দর্য। যখন তিনি ছন্দে থাকেন, তখন তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে নান্দনিক ব্যাটার।
তার প্রতিভা এতটাই স্পষ্ট যে মাত্র একটি ওয়ানডে খেলার পরই তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন ২০১৫ বিশ্বকাপ দলে। তবে টিম ম্যানেজমেন্ট তার প্রতিভা চিনলেও, তাকে আসলে কী ধরনের ব্যাটার তা বোঝেনি।
যে কোনো খেলোয়াড় থেকে সর্বোচ্চটা পেতে হলে আগে বুঝতে হবে সে আসলে কী দিতে পারে—ব্যবসায়িক পরিভাষা ধার করে বলা যায়, তার 'ইউনিক ক্রিকেটিং পয়েন্ট' (ইউসিপি) কী।
সৌম্যের ইউসিপি হলো তার স্বাভাবিক আগ্রাসন। অনেক ব্যাটারকে যেখানে বড় শট খেলতে জান-প্রাণ দেওয়ার মতন অবস্থা করতে হয়, সৌম্যের জন্য ঝুঁকি নিয়ে খেলা একেবারে সহজত স্বাভাবিক ব্যাপার।
তার বিস্ফোরক ঘরানার ব্যাটিং হয়তো দ্রুত উইকেট ফেলে দেওয়ার কারণ, কিন্তু যদি কিছুক্ষণ টিকে যান, তাহলে ইনিংসের গতি ইতিবাচকভাবে বদলে দেন।
পরিসংখ্যানও এই ধারণাকে সমর্থন করে: ওয়ানডেতে সৌম্যের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ৯৪.৯২—অন্তত ৩০ ইনিংস খেলেছেন বাংলাদেশের এমন ব্যাটারদের মধ্যে যা ইতিহাস সেরা।
এমন ব্যাটারকে নিয়মিত রান করার উপর নির্ভর করা কঠিন। তাত্ত্বিকভাবে তার গড়ও কম হওয়ার কথা। তবু সৌম্য ব্যতিক্রম।
বাংলাদেশের হয়ে যারা অন্তত ৫০ ইনিংসে ব্যাট করেছেন, তাদের মধ্যে সৌম্যের ৩৩.৪০ গড় পঞ্চম সর্বোচ্চ। তার অবস্থান কথিত চার পান্ডবের —সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকুর রহিমের ঠিক পরেই।
পরিসংখ্যান কখনও বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু সৌম্যের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট তাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। ওই চার জন যেখানে দুর্বল দলের বিপক্ষে বহু ম্যাচ খেলেছেন, সৌম্য তার পুরো ক্যারিয়ারে মাত্র দুইটি ওয়ানডে খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে—একটি ছিলো আবার তার অভিষেক ম্যাচ।
রানের পরিমাণ ও গতি মিলিয়ে দেখলে, সৌম্য তর্কসাপেক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাটারদের একজন।
বিশ্বমানেও তার রেকর্ড সম্মানের দাবিদার। ওয়ানডেতে টপ অর্ডারে অন্তত ৭৪ ইনিংস খেলেছেন এমন বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে মাত্র চারজনের গড় ও স্ট্রাইক রেট দুটোই সৌম্যের চেয়ে ভালো—জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো, ট্রাভিস হেড ও কোয়িনটন ডি কক।
সংখ্যাগুলো বলে দেয়, সৌম্য বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ওয়ানডে ব্যাটার, যিনি ৩২ বছর বয়সে এখনও দলের মূল ভরসা হওয়ার কথা।
দৃষ্টিভঙ্গি
তাহলে কেন সৌম্যকে আবারও ফেরার লড়াই করতে হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে? উত্তরটি, বব ডিলানের ভাষায়, 'ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড।'
সমালোচকরা তার ব্যর্থতা নয়, বরং যেভাবে তিনি আউট হন সেটাই বেশি চোখে আনেন। তার সীমিত ফুট মুভমেন্ট আসে নজরে, অথচ তার টাইমিংয় হলো মূল শক্তি—দেখতে লাগে অবহেলামূলক; তার লফটেড ড্রাইভ গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারলে মনে হয় বেপরোয়া। ফলে তার আউটগুলো যেন ক্ষমার অযোগ্য—যেন তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করছেন না।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দুরন্ত শুরুই বুমেরাং হয়েছে তার পরে গিয়ে। ২০১৫ সালে তিনি ১০২.২৮ স্ট্রাইক রেটে ৫১-এর বেশি গড়ে রান করেছিলেন, যা প্রত্যাশার মাত্রাকে অনেক ওপরে তুলে দেয়।
তারপরের বছরগুলোয় প্রত্যাশার ভার আর গড়ের অবনতি তাকে টেনে ধরেছে। সেই সঙ্গে ম্যানেজমেন্টে০র পরীক্ষা-নিরীক্ষা—মাঝে মাঝেই তাকে লোয়ার অর্ডারে পাঠিয়ে খেলানো হয়েছে মিডিয়াম পেস অলরাউন্ডার হিসেবে। অথচ ওপেনিংয়ে তার ব্যাটিং গড় ৩৫.৯৩, স্ট্রাইকরেট ৯৫.৯৯। যার ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান থেকে বেশি।
এই অনিশ্চয়তার মাঝেও সৌম্য ধরে রেখেছেন নিজের স্ট্রাইক রেট ও গড়—যা ভাবতে বাধ্য করে, যদি ম্যানেজমেন্ট প্রথম থেকেই তার আসল শক্তি বুঝে তাকে সেইভাবে গড়ে তুলত, তবে কী হতে পারত!
প্রকৃত সৌম্যকে ফিরে পাওয়া
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার সাম্প্রতিক ফেরা যেন আত্মবিশ্বাসেরই জয়গান। তিন ইনিংসে ১৪০ রান, যার মধ্যে ঘূর্ণি পিচে ৮৬ বলে ৯১ রানের ইনিংস—সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে, নিজের মতো খেললে সৌম্য কী দিতে পারেন।
৩২ বছর বয়সে তার এখনও কয়েক বছর ক্রিকেট বাকি, যথেষ্ট সময় দেশের হয়ে আরও অবদান রাখার আছে।
আশা করা যায়, অন্তত এখন থেকে সিস্টেম তাকে তার মতো থাকতে দেবে—তাকে বানানোর চেষ্টা করবে না এমন কেউ হিসেবে, যা আসলে তিনি নন।


Comments