চাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থী কেন মাত্র ১১ শতাংশ, যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে নারী ভোটার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হলেও প্রার্থী হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ অনেকাংশেই কম।
নির্বাচনে মোট ৪২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী মাত্র ৪৮ জন, যা মোট প্রার্থীর মাত্র ১১ শতাংশ।
এর মধ্যে শীর্ষ তিন পদ সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন মাত্র ৩ জন নারী শিক্ষার্থী। ৬টি গুরুত্বপূর্ণ পদে কোনো নারী প্রার্থীই মনোনয়ন নেননি।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের চাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ২৭ হাজার ৬৩৭ জন। নারী ভোটারের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ না করা হলেও, ভর্তি ও আবাসিক তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৪০-৪৫ শতাংশ ভোটার নারী।
কোন পদে কতজন নারী প্রার্থী
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চাকসু নির্বাচনে ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ১২ জন, সহ-ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ১১ জন নারী প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েছেন।
এছাড়া, নির্বাহী সদস্য পদে ৬, পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৩, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে ২, যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ২, সমাজসেবা ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ২ জন নারী প্রার্থী আছেন। বাকি পদগুলোতে নারী প্রার্থীর সংখ্যা এক বা শূন্য।
পিছিয়ে থাকার কারণ
সংশ্লিষ্টদের মতে, চাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থী কম হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে—ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা, সাংগঠনিক সহায়তার অভাব, পরিবার ও সমাজ থেকে অনুৎসাহ, সাইবার হয়রানির ভয়, আবাসন সমস্যা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও কেন্দ্রীয় ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সুমাইয়া শিকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নারী প্রার্থী কম হওয়ার মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নারীবিদ্বেষী মনোভাব। আমরা একটি শিক্ষার্থী-বান্ধব প্রশাসন চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। এতে নারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে।'
'অনেকে ভাবছেন, নির্বাচনে দাঁড়ালে হয়ত হেনস্তার শিকার হতে হবে। অনলাইন কিংবা অফলাইনে আমার পরিচিত অনেকে এই আশঙ্কায় প্রার্থী হতে এগিয়ে আসেননি,' বলেন তিনি।
নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশরেকা অদিতি হক বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে নারীদের যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেটি তারা পাননি। বরং গত এক বছরে আমরা দেখেছি প্রশাসন নারীবান্ধব না হয়ে নারীবিদ্বেষী মনোভাব প্রদর্শন করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিজয় ২৪ হলে বহিরাগতদের হামলায় ভাঙচুরের ঘটনায় নারীদের দায়ী করা হয়েছিল এবং তাদের ৯ জনকে বহিষ্কার করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষও নারী শিক্ষার্থীকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। এসব ঘটনায় নারীরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো কার্যকর সহযোগিতা পাননি। বরং আমরা দেখেছি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি ও বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে, যা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপরাধমূলক বিষয়।'
সার্বিক চিত্র
চাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে এবারে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে ৯৩১টি। তবে, নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ না হওয়ায় নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের কার্যকর উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতে, নিরাপদ পরিবেশ, সংগঠনিক সুযোগ এবং আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে আগামীতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়তে পারে।
চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ঈশা দে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সব জায়গায় পুরুষতান্ত্রিক একটা মনোভাব দেখতে পারি। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক কিংবা অন্য কোনো জায়গায়। জুলাই আন্দোলনে নারীদের যে ভূমিকা ছিল সেটি অনেকটাই কমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সুযোগ করে দিতে পারেনি বলে চাকসু নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম। নারীদের প্রতি সমাজে যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এটা বদলালে নারীদের অংশগ্রহণ আগামীতে আরও বাড়বে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাকসু নির্বাচন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেকদিন চাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কম। এছাড়াও বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরাও চাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না তেমনভাবে। অনেকে জানে না যে চাকসু আসলে কী। নির্বাচনের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তাহলে পরবর্তীতে আমি মনে করি নারী শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ পরবর্তীতে বাড়বে।'
তফসিল অনুযায়ী, চাকসু নির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই চলছে। প্রাথমিক প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের তারিখ আজ রোববার হলেও রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তা প্রকাশ হয়নি।
আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। আর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১২ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
Comments