মুদ্রার মান ধরে রাখতে রিজার্ভ থেকে খরচের কোনো মানে হয় না: শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদ

শ্রীলঙ্কা
দুশনি বীরাকুন। ছবি: সংগৃহীত

ক্রমান্বয়ে মুদ্রার দাম কমানোর অনুমতি দেওয়া বাংলাদেশের জন্য নীতিগত অগ্রাধিকার হওয়া উচিত এবং এটিই হতে পারে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা—এমন মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির এক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ।

শ্রীলঙ্কার ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক দুশনি বীরাকুন বলেন, 'আপনি যদি বৈদেশিক খাতের চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রার বিনিময় হার সামঞ্জস্য করতে না দেন, তাহলে একবার রিজার্ভ কমতে শুরু করলে আপনি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সংকটে পড়বেন।'

গত সপ্তাহে ঢাকায় সাউথ এশিয়া ইকোনমিক সামিটের ফাঁকে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে এ কথা বলেন।

'তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারে এমন রিজার্ভ নিশ্চিত করা একটি মৌলিক নিয়ম' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'রিজার্ভ যদি আমদানির তিন মাসেরও কম সময়ে চলে আসে, তাহলে আপনি অর্থনৈতিক সংকটে পড়বেন।'

দুশনি বীরাকুন এমন সময় এ মন্তব্য করলেন যখন বাংলাদেশে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি বিল বেশি হওয়ায় দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ অর্ধেকে নেমে এসেছে।

সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, আমদানি বিল পরিশোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা চার মাসের নিচে। যদিও তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তিন মাসের মানদণ্ডের চেয়ে বেশি।

'যেহেতু আমাদের কাছে নীতিগত বিকল্প খুব কম ছিল, তাই অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে আমাদের এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। আগামী ছয় থেকে ১২ মাস আমাদের তা ধরে রাখতে হবে। এটি সহজ হবে না, কারণ আগামী বছর নির্বাচন আছে।'

প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি করে দেওয়ার নীতি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর নয়, যদি না দেশটির বৈদেশিক আয় বেশি থাকে।

'পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে আসবে যখন আপনি আর মুদ্রার মান ধরে রাখতে পারবেন না। আমি বলব, আপনার অবশ্যই বাস্তবসম্মত মুদ্রা বিনিময় হার থাকতে হবে। যদি বৈদেশিক খাতের চাপ থাকে তবে মুদ্রার নির্দিষ্ট বিনিময় হার বজায় রাখতে রিজার্ভ থেকে খরচ করার কোনো মানে হয় না।'

রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকায় গত ১৮ মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিনিয়োগ বোর্ডের আর্থিক বোর্ডে কাজ করা দুশনি বীরাকুন রিজার্ভ সংকটে পড়ার আগে আইএমএফের কাছে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের তাত্ক্ষণিক উদ্যোগের প্রশংসা করেন।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ এমন কাজ করেছে, যা আমরা করিনি। চ্যালেঞ্জিং অবস্থানে আসার আগেই বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে গিয়েছিল।'

শ্রীলঙ্কার সংকট বাংলাদেশকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে সহায়তা করেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ইতিবাচক উত্তর দিয়ে বলেন, 'আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে আছে।'

'এর অর্থ হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা আরও আত্মবিশ্বাসী হবেন। বাংলাদেশের খুব বেশি বাণিজ্যিক বৈদেশিক ঋণ নেই। যা আছে তা সামলে নেওয়া যাবে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আপনার রেয়াতি ঋণ ও অনুদান পাওয়ার সুযোগ আছে।'

শ্রীলঙ্কা কীভাবে এই সংকটে পড়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেন, 'শ্রীলঙ্কায় বড়মাপের রাজস্ব ঘাটতি ও বিশাল বৈদেশিক চলতি অ্যাকাউন্ট ঘাটতি চলছিল। আমরা সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছিলাম। খরচ মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছিলাম।'

এই অর্থনীতিবিদ জানান, ২০১০ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ ঋণ বাণিজ্যিক শর্তে নেওয়া হয়।

২০১৯ সালে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চেয়েছিল। তাই দ্রুত কর কমানো হয়। এতে আর্থিক ঘাটতি বাড়তে শুরু করে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রীলঙ্কার নিজস্ব ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দেয়।

অর্থনীতিবিদ বীরাকুন বলেন, 'অর্থাৎ কলম্বো পুঁজিবাজারে প্রবেশ ও ঋণ পরিশোধে সক্ষম ছিল না। এরপর করোনা মহামারি আসে।'

তিনি আরও বলেন, 'শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছিল। যারা অর্থনৈতিক নীতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন তারা ভেবেছিলেন যে তারা আইএমএফের কাছে না গিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবেন। কারণ দেশটি চীন ও ভারতের কাছ থেকে আরও বেশি ঋণ নিতে পারবে।'

'কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। অর্থনীতি সংকট পড়েছিল এবং আমরা ঋণ পরিশোধ করতে পারিনি। ২০২২ সালের এপ্রিলে আমরা খেলাপি হই।'

'শ্রীলঙ্কা আইএমএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পেয়েছিল। সুদের হার বাড়িয়ে এবং মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার অনুমতি দিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে সমন্বয় করে।'

'ফলে, মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। স্থানীয় মুদ্রার মান ৮০ শতাংশেরও বেশি কমে গিয়েছিল। জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার ছিল না এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছিল।'

'যেহেতু আমাদের কাছে নীতিগত বিকল্প খুব কম ছিল, তাই অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে আমাদের এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। আগামী ছয় থেকে ১২ মাস আমাদের তা ধরে রাখতে হবে। এটি সহজ হবে না, কারণ আগামী বছর নির্বাচন আছে।'

'অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তাকারী নীতি চলমান রাখার বিষয়ে আসন্ন নির্বাচন অনিশ্চয়তা তৈরি করছে,' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

শ্রীলঙ্কা সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে পেরেছে। গত ১২ মাস ধরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে দুশনি বীরাকুন বলেছেন, 'শ্রীলঙ্কা এখনো সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।'

পণ্য সরবরাহে ঘাটতি বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট না থাকলেও মানুষের জীবনযাত্রার মান কমেছে।

এ বছর অর্থনীতি তিন শতাংশ কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন নেই।

তিনি আরও বলেন, 'অনেক শ্রীলঙ্কান অভিবাসী হচ্ছেন। চাকরির খোঁজে দেশ ছাড়ছেন।'

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia contribution to Bangladesh democracy

A leader who strengthened our struggle for democracy

Khaleda Zia leaves behind an enduring legacy of service.

13h ago