অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস

গতি ফিরছে না অর্থনীতিতে

মূল্যস্ফীতির চাপে দেশবাসী জর্জরিত। ছবি: স্টার ফাইল ফটো
মূল্যস্ফীতির চাপে দেশবাসী জর্জরিত। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

গত কয়েক বছর ধরেই খাবারসহ রোজকার অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম কমবে এই আশায় অপেক্ষা করছিলেন রিকশাচালক আহসান। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর গেলেও সেই আশা কেবল দূরাশাই থেকে গেছে তার। পঞ্চাশোর্ধ্ব আহসানের কাছে এই ভার এখন অসহনীয়।

এরই মধ্যে গত আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানুয়ারিতে টানা দ্বিতীয় মাসের মতো মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু তাতে আহসানের কষ্ট কিছু কমেনি, তবে তার পরিবারের জীবনযাত্রার মান কমেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস নিয়ে জানতে চাইলে আহসান বলেন, 'আমার জীবনের তেমন কোনো পরিবর্তন তো আমি দেখলাম না।'

'বাজারে শুধু আলুর দাম কমছে, বাকি সব কিছুরই তো দাম বেশি।'

চার সন্তানসহ ছয় সদস্যের পরিবারে আহসানই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রতিদিন যে ৭০০ টাকার মতো তার আয় হয় তা দিয়ে বাড়িভাড়াসহ সব খরচ মেটানো সম্ভব হয় না।

'এই আয় দিয়ে ক্যামনে আমি আমার পরিবারের তিন বেলার খাবার জোগাড় করি?'

ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে আহসানদের মতো নিম্ন আয়ের লাখো মানুষের বসবাস। রোজকার জীবনযুদ্ধে তাদের প্রায় সবার গল্পই একই।

আহসান জানান, আগে এক কেজি চাল কিনতে ৫০ টাকার কম খরচ হলেও এখন সেই চাল কিনতে ৫০ টাকার অনেক বেশি দাম দিয়ে হয়। অন্যদিকে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় রান্নার তেলের জন্যও গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে টানা ২৩ মাস ধরে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি টেনে চলা মানুষের কাছে তাই এই বাড়তি খরচ 'বোঝার ওপর শাকের আঁটি'।

আর যদি বৃহত্তর অর্থনীতির দিকে তাকানো যায় সেখানেও অর্থনীতিবিদ কিংবা ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তার কালো মেঘের কথা বলছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'অর্থনীতি এখনও ছয় মাস আগের ঝুঁকি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। তবে কয়েকটি সূচকে উন্নতি এবং আরও কয়েকটি সূচক নিয়ন্ত্রণে থাকায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।'

গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে তার প্রভাব পড়েছে সামান্য। এখনো খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি।

গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৩-২৪ শতাংশে স্থির হয়ে আছে। এছাড়াও বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের চিত্রও আশার আলো দেখাচ্ছে না।

আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগ খাতে অনিশ্চয়তার কারণে টানা পঞ্চম মাসের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণের প্রবাহ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গত কয়েক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তার মতে স্থবিরতার এই ধারা চলমান। 'দেখে মনে হচ্ছে অর্থনীতি দুষ্টচক্রে পড়েছে।'

তিনি বলেন, 'সরকারের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বাড়ছে যেটা বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।'

প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড় আরও উঁচু হচ্ছে বলেও জানান এই অর্থনীতিবিদ।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, 'অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার আমদানি বিধিনিষেধ শিথিল করাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে ব্যাংকিং খাত, কর ও প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয় রয়েছে।

গত ছয় মাসে দেশের জনগণ ও বেসরকারি খাতের দৃঢ়তায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'এইসব প্রচেষ্টার পরও, চলমান চ্যালেঞ্জগুলো অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।'

'বিনিয়োগে ধীরগতি ও শিল্পখাতে স্থবিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ১ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।'

লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি, দুর্বল ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিকে আরও চাপে রেখেছে।

তার মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে আসা ও অনাদায়ী ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তা বেড়েছে।

ঢাকা চেম্বার সভাপতির মতে, ব্যবসায়িক আস্থা কমেছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ বেশ কিছু সংকট উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। সেখান থেকে বের হতে পারেনি।

'আমরা আশা করেছিলাম অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। কয়েকটি সুচকে -- রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ পতন ঠেকানো ছাড়া তেমন কোন অগ্রগতি আমরা তা দেখিনি।

তিনি যোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে অর্থনীতিতে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আস্থার এই সংকট বিনিয়োগকারী ও ভোক্তা উভয়েরই বলে জানান তিনি।

অর্থনীতি চাঙা ও সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি উপদেষ্টাদের মধ্যে সমন্বয়কে গুরুত্ব দেন তিনি। বলেন, 'উপদেষ্টাদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য ও অবস্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি।'

সেলিম রায়হানের মতে, সম্প্রতি ধানমন্ডি-৩২ নম্বরসহ সারা দেশে ভাঙচুরের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা কথা জানান তিনি। 'পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের বাকি মাসগুলোয় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এমন সম্ভাবনা কম।'

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, 'ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে গত কয়েক মাস ধরে ব্যবসা পরিবেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, 'টাকার মান কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এতে আমদানি খরচ অনেক বেড়েছে।'

এদিকে, সুদের হার বেড়ে তহবিল খরচ বাড়তে থাকায় ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) উদ্যোক্তারা তাদের উদ্যোগ চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারক ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার বলেন 'এখন পর্যন্ত যেসব সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো কিছুটা আশার আলো দেখালেও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।'

'আমরা যদি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হই তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমবে।'

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিমের মতে, গত ছয় মাসে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর অবস্থা 'অম্লমধুর'।

তিনি কয়েকটি সূচকের উন্নতির কথা উল্লেখ করে বলেন— যেমন চলতি হিসাব ব্যালেন্স ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। আগের ঘাটতি থেকে এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।

'এই উন্নতির পরও উদ্বেগ কিন্তু থেকেই গেছে। চলমান অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।'

বাড়তি খরচের ভার নিয়েও একই কথা সেই রিকশাচালক আহসানের মুখেও: দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।

রাজধানীর বাংলামোটর এলাকা থেকে ফার্মগেট যাওয়ার পথে রাস্তার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে তার কণ্ঠে ক্লান্তি আর অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। 'রোজ সেই একই অবস্থা। মনে হয় রোজ খালি রোজগারের চিন্তা না বাঁইচা থাকার জন্যেও লড়াই করতে হয়।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh airport cargo fire losses

Airport fire may delay RMG, pharma production by at least two months

Local manufacturers are scrambling for raw materials after a massive fire destroyed imported production inputs at the cargo complex of Dhaka airport on Saturday.

10h ago