পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমেছে
দেশের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। ফলে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেও একই প্রবণতা দেখা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই–অক্টোবর সময়ে তালিকাভুক্ত শেয়ারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ৬৬ মিলিয়ন ডলার কমেছে। অর্থাৎ এই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বেশি।
এর আগের বছরের একই চার মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বের হয়ে যাওয়ার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক অনেক কম, তখন কমেছিল ৯ মিলিয়ন ডলার।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আর্থিক খাতের উদ্বেগও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতের কিছু জায়গায় যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা অন্য ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন।
তিনি জানান, বর্তমানে মাত্র চার থেকে পাঁচটি ব্যাংক তুলনামূলক স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু বাকি ব্যাংকগুলো নানা ধরনের চাপে আছে। ফলে আর্থিক খাতের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি তালিকাভুক্ত ব্যাংক একীভূত করছে, কারণ এসব ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা হারিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক নয়টি ব্যাংক বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসানয়নের (লিকুইডেশন) প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে, যার মধ্যে আটটিই তালিকাভুক্ত। এসব ঘটনা বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের ব্যয় ক্ষমতা কমে গেছে। এতে ভোগ্যপণ্য খাতের কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এসব কোম্পানির চাহিদা কমেছে।
তার মতে, নতুন ও ভালো কোম্পানির অভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ পাচ্ছেন না।
তার ভাষ্য, 'কিছু তালিকাভুক্ত কোম্পানি মোটামুটি ভালো করলেও অনেক কোম্পানির লভ্যাংশ দেওয়ার রেকর্ড ভালো না।'
তিনি মন্তব্য করেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে কোনো বড় ও সুশাসিত কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। সাধারণত এ ধরনের কোম্পানি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে।
এছাড়া গত এক বছরে কোনো আইপিও অনুমোদন পায়নি, যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মে মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত তার ব্রোকারেজ হাউসের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানির যোগাযোগের ঘাটতি ও দুর্বল করপোরেট সুশাসন রয়েছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সময়মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা প্রয়োজনে কোম্পানির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পান না। ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আগ্রহ পান না।
কিছু বাজার বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আগে নেওয়া কিছু নীতির কারণে ব্যবসা একপ্রকার থেমে গিয়েছিল, তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন সতর্ক।
ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রহমত পাশা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয়।
তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়া না পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারী বাজারে আসতে চান না। কারণ তারা সহিংসতা বা হঠাৎ অর্থনৈতিক সমস্যাকে এড়িয়ে চলতে চান।
রহমত পাশা জানান, ২০২০ ও পরে ২০২২ সালে নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইস নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখনো সতর্ক। এই নীতির কারণে অনেক শেয়ার সহজে কেনা-বেচা যায়নি, তাই বাজার ধীর হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন এবং তাদের নিজ দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ম মানতে সমস্যা হয়েছে। কারণ ওই সংস্থাগুলো এ ধরনের বাজারে বিনিয়োগের অনুমতি দেয় না।
তিনি বলেন, নতুন কমিশন গত বছরের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর ফ্লোর প্রাইস নীতি তুলে নেওয়া হয়। তবে এখানো বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্ণ আস্থা ফেরেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৩৪৩ মিলিয়ন ডলার।
ব্রোকারদের মতে, কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন কিছু শেয়ারে সম্ভাবনা দেখছেন, কিন্তু শুধু কম দামের কারণে তারা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।
তাদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগ স্থিরভাবে ফিরতে হলে দরকার রাজনৈতিক স্থিরতা, স্বচ্ছ বাজার নিয়ম, ভালো কোম্পানি পরিচালনা এবং নতুন মানসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তি।
ব্রোকাররা বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও বাজারের নীতিমালা আরও স্পষ্ট হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে বাজারে ফিরবেন।

Comments