আলমগীর কবিরের সেরা ৫ সিনেমা

আলমগীর কবিরের সেরা ৫ সিনেমা
ছবি: কোলাজ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে আলমগীর কবির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি কেবল একজন কাহিনীকার বা পরিচালকই নন, বরং তার কাজ চলচ্চিত্র মাধ্যমকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে ১৯৭০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশকের মধ্যে তিনি যে চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেসব সিনেমা আজও দর্শক ও সমালোচকদের মনে চিরস্থায়ী আসন নিয়ে রয়েছে। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শ্রেষ্ঠ ১০ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায় তার তিনটি সিনেমা স্থান পেয়েছে।

১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন আলমগীর কবির। ফেরি দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি। তার জন্মদিনে দেখে নিতে পারেন তার নির্মিত সেরা পাঁচ সিনেমা।

১. সূর্য কন্যা (১৯৭৫)

'সূর্য কন্যা' ছিল আলমগীর কবিরের নির্মিত দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যা সমাজ ও মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বকে একটি কল্পনাপ্রবণ গল্পের ভেতর দিয়ে মানবিকভাবে উপস্থাপন করে। ছবির প্রধান চরিত্র লেনিন—একজন স্বাপ্নিক চিত্রশিল্পী, যার জীবনের পটভূমি ও সামাজিক বাস্তবতা তাকে তার জীবনের কঠিন পরিস্থিতি থেকে বারবার কল্পনার ভুবনে নিয়ে যায়। বাস্তবে সে নীরবে মার্জিত জীবনযাপনে আটকা থাকলেও কল্পনায় সে একে একে ভালোবাসা, শিল্প, স্বাধীনতা, মানবতাবোধ—যা সে বাস্তবে পায় না, সেসব জিনিসকে নিজের ভেতর সাজিয়ে নেয়।

এই ছবিটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান, মানুষের ব্যক্তিগত স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাত—এসব বিষয়গুলোর কথা সরাসরি না বলে কল্পনার মাধ্যমে প্রতিফলিত করে। এখানে একটি ম্যানিকুইন (নারী মূর্তি) প্রেমের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং লেনিন তার ভেতরের অনুভূতিকে তার কাছে মানসিকভাবে প্রতিফলিত হতে দেয়। সিনেমা চলাকালীন দর্শক শুধু প্রেমের গল্পই দেখেন না, বরং সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব, নারীর স্বাধীনতা ও সামাজিক বিধি‑বস্তুর মোকাবিলার কথাও উপলব্ধি করেন। লেনিনের কল্পনায় প্রেম ও মানবতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে যায়—যা চলচ্চিত্রটিকে কেবল প্রেমকাহিনী করে রাখে না, বরং একটি বক্তব্যধর্মী ইমেজও দেয়।

চলচ্চিত্রটির সংগীত, বিশেষ করে 'আমি যে আঁধারের বন্দিনী' গানটি অনুভূতি ও আবেগের সঙ্গে গল্পের বার্তাকে শক্তিশালী করেছে, যা এখনো দর্শকদের মনে দাগ কেটে যায়। অবিস্মরণীয়, অসামান্য এই সিনেমাটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শ্রেষ্ঠ ১০ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায়ও স্থান পেয়েছে৷

২. সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭)

'সীমানা পেরিয়ে' ছিল আলমগীর কবিরের তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং এটি ১৯৭০-এর দশকের সামাজিক ও মানসিক সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার গল্প বলে। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এক নির্জন দ্বীপে আটকে পড়া ভিন্ন শ্রেণির দুজন নর-নারীকে নিয়ে সিনেমার গল্প। এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন জয়শ্রী কবির ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনয়শিল্পীরা এবং এটি একটি রোমান্স‑ড্রামা হলেও এর মর্ম হলো মানুষের মনের ভেতরের সীমা, সম্পর্কের বাধা, সামাজিক কাঠামো ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।

ছবির নায়ক (বুলবুল আহমেদ) তার প্রেম, সম্মান ও জীবনযাত্রার প্রশ্নগুলোর সঙ্গে লড়াই করে—প্রেমের সীমা, সামাজিক প্রত্যাশা ও অপরের বিচারে হয়রানি—এসবকে পেরিয়ে যেতে চায়। এখানে সীমা মানে শুধুই ভৌগলিক বা সামাজিক সীমা নয়; তা মানসিক সীমা ও নিজেকে খুঁজে বের করার সাহসও। বুলবুল আহমেদের অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ অভিনেতা) পান এবং একইসঙ্গে আলমগীর কবির নিজের লিখিত চিত্রনাট্য ও সংলাপের জন্যও সেই সম্মান অর্জন করেন। চলচ্চিত্রটি দর্শকদের সামনে স্নায়ুচাপে ভরা আবেগ, প্রত্যয়ের কথা তুলে ধরে—যে সব সীমাকে মানুষ নিজের ভেতর থেকে জয় করার চেষ্টা করে।

৩. মহানায়ক (১৯৮৪)

'মহানায়ক' ১৯৮৪ সালের একটি নাট্যধর্মী সামাজিক চলচ্চিত্র, যেখানে গল্পটি নানাবিধ সংকটে পতিত এক যুবকের জীবনের সংগ্রাম ও আত্মপরিচয়ের দিকে এগিয়ে যায়। এখানে প্রধান চরিত্রে ছিলেন বুলবুল আহমেদ, যিনি অপরাধ, প্রেম, ব্যর্থতা ও পুনর্জাগরণের মতো বিভিন্ন দিকের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যান। ছবিটির গল্পে নায়কের জীবনে বেকারত্ব, বন্ধুত্ব, খামতি, অপরাধ, সম্পর্ক ও শেষে আত্মোপলব্ধি অর্জন—এসব মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক দিকগুলোকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

ছবিতে দর্শক দেখতে পান কীভাবে একজন সাধারণ যুবক জীবনের কঠিন পরিস্থিতির মাঝে নিজেরই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিপথগামী হয়, আবার কীভাবে সে নিজেকে ফিরিয়ে আনে সামাজিক ও নৈতিক বাধাগুলোর মধ্য দিয়ে। মহানায়ক শুধু একটি প্রেম‑সংগ্রামের গল্প নয়—এটি মানুষের নিজের ভুলের পথে লড়াই, ক্ষমা, উন্নতি ও পুনর্জন্মের ব্যথা তুলে ধরে।

বুলবুল আহমেদের অভিনয় ও সিনেমায় শেখ সাদী খানের সংগীত এই আবেগীয় যাত্রাকে আরও গভীর করেছে, ফলে এটি বাংলা চলচ্চিত্রের একটি স্মরণীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. রূপালী সৈকতে (১৯৭৯)

'রূপালী সৈকতে' ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এমন একটি প্রেম ও জীবন‑সংগ্রামকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র, যেখানে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের আবেগের মিলনকে শিল্পসম্মতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছবির কাস্টে ছিলেন বুলবুল আহমেদ, জয়শ্রী কবির, শর্মিলী আহমেদসহ আরও অনেকে। এটি সেই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে দৃশ্যধারণ কৌশল, আবহ সংগীতের ব্যবহার, গল্পের সৌন্দর্য ও আবেগীয় গভীরতার কারণে বিশেষভাবে স্মরণীয়।

ছবির পটভূমিতে রয়েছে সৈকতের নির্জন পরিবেশ, যেখানে প্রেম, বিচ্ছেদ, আত্মজিজ্ঞাসা ও মানুষের জীবনের বিচিত্র অনুভূতি একসঙ্গে মিলিত হয়। এটি কেবল একটি প্রেমের গল্প নয়, বরং সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ‑আনন্দের মিলন, সম্পর্কের জটিলতা ও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি—এসবকেই গল্পের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। ছবিটি 'বাচসাস বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড' জিতেছিল এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শ্রেষ্ঠ ১০ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে৷ এই সিনেমাটি বাংলাদেশের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

৫. ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)

'ধীরে বহে মেঘনা' ছিল আলমগীর কবিরের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত অন্যতম প্রামাণিক ও শিল্পসম্মত কাজ। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায় এবং যুদ্ধের পরের সময়ের বাস্তবতার ওপর কেন্দ্র করে নির্মিত—যে সময় পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটছে, আর সাধারণ মানুষ বাঁচার চেষ্টা করছে।

ছবির গল্পের কেন্দ্রে একটি বাঙালি পরিবারকে দেখানো হয় যারা পাকিস্তান সেনা ও গণহত্যা থেকে বাঁচতে নদী পথে পালাচ্ছে, আশার খোঁজে মেঘনা নদীর দিকে ছুটে চলেছে এবং প্রতিকূলতার মুখে মানবিকতা ও বিশ্বাস ধরে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সিনেমার নামটিই—'ধীরে বহে মেঘনা'—প্রতীকী অর্থে যেমন নদীর ধীর গতির প্রবাহকে নির্দেশ করে, তেমনি দেশের মানুষের জীবনের প্রতিকূলতা, অনিশ্চয়তা, দুঃখ, প্রত্যাশা ও অটুট দৃঢ়তাকেও তুলে ধরে। 
চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব প্রামাণ্য ফুটেজ ব্যবহার করার সাহসী প্রয়াস ছিল সেই সময়ের বাংলা সিনেমায় অত্যন্ত নতুন ও গতিশীল ধারণা। দর্শক মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠে চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে, যেখানে যুদ্ধ শুধু শক্তির সংঘাত নয়—বরং, মানুষের অভিজ্ঞতা, বেদনা ও আশার প্রতীক হিসেবে প্রতিফলিত হয়।

এই ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শ্রেষ্ঠ ১০ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায় সিনেমাটি স্থান পেয়েছে, যা বাংলাদেশে চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা।

Comments