যেভাবে আসামের সংস্কৃতির আইকন হয়ে ওঠেন জুবিন

জুবিন গার্গা । ছবি: সংগৃহীত

সংগীতের আলাদা শক্তি আছে। সংগীতকে কখনো ভৌগলিক সীমারেখায় আটকানো যায় না। তেমন কিছু শিল্পী আছেন যাদের কণ্ঠস্বর ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। জুবিন গার্গ ছিলেন সেই বিরল শিল্পীদের একজন।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং দুর্ঘটনায় তার আকস্মিক মৃত্যু হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক আইকনের চলে যাওয়ায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে লাখ লাখ ভক্ত।

মেঘালয়ের তুরায় ১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর জন্ম নেওয়া জুবিন ছোটবেলা থেকেই সংগীতচর্চায় মন দেন। তার মা ইলি বরঠাকুর ছিলেন কবি ও গায়িকা, আর বাবা মোহিনী মোহন বরঠাকুর (ছদ্মনাম কপিল মেহতা) ছিলেন সংগীতপ্রেমী। বিখ্যাত সুরকার জুবিন মেহতার নামানুসারে তার নাম রাখা হয় জুবিন। ছোট বোন জনকি বরঠাকুর ছিলেন অভিনেত্রী ও গায়িকা। তার বোনের মৃতু হয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনায়।

বিমানবন্দর থেকে জুবিনের মরদেহ আনার সময় উপচে পড়া ভিড়। ছবি: সংগৃহীত

শিশুকালেই তিনি নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করেন জুবিন। তিন বছর বয়সে সংগীতে হাতেখড়ি। এর ১১ বছর পর তবলার তালিম। তারপর নিজে নিজে গিটার, হারমোনিয়াম, ম্যান্ডোলিনসহ নানা বাদ্যযন্ত্র শিখে ফেলেন। জুবিন ঢোল, দোতারা, গিটার, হারমোনিকা, হারমোনিয়াম, ম্যান্ডোলিন, কি-বোর্ড, তবলাসহ ১২ ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন।

তার প্রথম অ্যালবাম অনামিকা (১৯৯২) উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। ওই সময়ে 'অনামিকা', 'স্বপ্নের সুর', 'জোনাকি মন', 'মায়া' ইত্যাদি অ্যালবাম তাকে আসামের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। অল্প সময়ে হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া গায়ক।

পরে ১৯৯৫ সালে তিনি মুম্বাই যান এবং বলিউডে গান গাওয়া শুরু করেন। তখন বেশি কিছু বলিউড সিনেমাতে গান করেন। তবে তার সবচেয়ে বড় হিট আসে ২০০৬ সালে গ্যাংস্টার সিনেমার 'ইয়া আলি' গান দিয়ে। এই গান তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ২০০৭ সালে হিন্দি অ্যালবাম জিন্দেগি প্রকাশিত হয়। বলিউডে তিনি শতাধিক হিন্দি গান রেকর্ড করেছেন।

জুবিন গার্গের ছবিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এক ভক্ত। সংগৃহীত

কিন্তু কেবল বলিউড নয়, জুবিন নিজের শিকড় ভুলে যাননি। আসামিয়া সিনেমাতে তিনি ছিলেন প্রথম সারির নায়ক ও গায়ক। তিনি অসংখ্য সিনেমাতে কাজ করেছেন। মিশন চায়না প্রমাণ করে দিয়েছিল, আঞ্চলিক সিনেমাও ব্লকবাস্টার হতে পারে।

তিনি বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলেগু, নেপালিসহ ৪০টিরও বেশি ভাষায় গান গেয়েছেন। এভাবে তার কণ্ঠস্বর পেয়েছে বৈশ্বিক পরিচয়।

শিল্পীর পাশাপাশি জুবিন ছিলেন সমাজকর্মী। তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের বন্যার্তদের সাহায্য, চিকিৎসা সহায়তা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তহবিল সংগ্রহে জড়িত ছিলেন।

করোনাকালে নিজের বাড়ি পর্যন্ত কোভিড কেয়ার সেন্টার হিসেবে দিয়ে দেন। আবার রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে আসামে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে তার গান হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা।

স্ত্রী গরিমার সঙ্গে জুবিন গার্গ । ছবি: সংগৃহীত

২০০২ সালে গরিমা সাইকিয়াকে বিয়ে করেন। জুবিন তার প্রেমজীবন নিয়ে সরাসরি কথা বলতেন। ছাত্রজীবনে 'জুনমনি রুনঝুন' গানটি দুই বান্ধবীর নাম থেকে লিখেছিলেন। তার স্ত্রী গরিমা সাইকিয়া গার্গ একজন খ্যাতনামা ফ্যাশন ডিজাইনার। গরিমা আনামিকা ও মায়া শুনে তিনি জুবিনকে চিঠি লিখেছিলেন। সেখান থেকেই তাদের পরিচয় ও প্রেম শুরু হয়। অবশেষে ২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারা বিয়ে করেন।

জুবিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা উত্তর-পূর্বসহ পুরো ভারতে শোকের ছায়া নেমে আসে। আসামের মানুষের কাছে তিনি কেবল একজন গায়ক নন, ছিলেন তাদের উৎসবের সঙ্গী, তাদের আন্দোলনের কণ্ঠস্বর ও সংস্কৃতির প্রতীক।

জুবিন গার্গ । ছবি: সংগৃহীত

জুবিন গার্গ প্রমাণ করে গেছেন, শিল্প কেবল বিনোদন নয়। এটা মানুষের মন, সমাজ ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন। তিনি চলে গেলেও তার গান, সিনেমা, কবিতা ও সমাজসেবামূলক কাজ চিরকাল বেঁচে থাকবে মানুষের মনে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রকস্টারের কণ্ঠস্বর চিরকাল প্রতিধ্বনিত হবে বন-নদী-পাহাড় ও মানুষের হৃদয়ে। সত্যিই কিছু কণ্ঠস্বর কখনো মুছে যায় না, বরং চিরকাল থেকে যায় মানুষের স্মৃতিতে।

Comments

The Daily Star  | English

15 army officers in custody taken to tribunal amid tight security

The International Crimes Tribunal-1 is set to review the progress of two cases of enforced disappearance

47m ago