ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছেই না, রেফারে দেরি ও সচেতনতার ঘাটতি মৃত্যুর বড় কারণ

সোমবার নতুন করে আরও পাঁচজনের মৃত্যুর পর এ বছর সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৫ জনে। সংখ্যাটি উদ্বেগজনক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান হলো—
- জানুয়ারি—১০ জন
- ফেব্রুয়ারি—৩ জন
- মার্চ—০
- এপ্রিল—৭ জন
- মে—৩ জন
- জুন—১৯ জন
- জুলাই—৪১ জন
- আগস্ট—৩৯ জন
- সেপ্টেম্বর (১৪ পর্যন্ত)—৩৩ জন
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়—৭৮ জনের। এরপর বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ জন করে এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৬৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন রোগী যুক্ত হওয়ায় এ বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৫২৭ জনে।
বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুহার বৃদ্ধির কারণ কী বলছেন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান বলেন, 'দেরিতে হাসপাতালে আসা, আগের তুলনায় ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগ কমে যাওয়া, আগের মতো গুরুত্ব না দেওয়া, অন্যান্য রোগের সঙ্গে একযোগে আক্রান্ত হওয়া এবং রোগীদের ঢাকায় রেফার করা—এসবই মৃত্যুহার বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।'
তিনি বলেন, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও মৃত্যুহার বেড়েছে। কারণ, অন্যান্য ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় মানুষ ডেঙ্গুকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।'
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে দেশে চার ধরনের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে—ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও কোভিড-১৯।
হাসপাতালে রেফার বিলম্ব ও জটিলতা
ডা. নাজমুল আহসান বলেন, 'অনেক রোগী গুরুতর পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, তীব্র অবসাদ, প্রস্রাবের পরিমাণ বা প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলো যে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেটা বুঝতে পারছেন না। যার কারণে, দেরি করে হাসপাতালে আসার পর দেখা যাচ্ছে, অনেকের অবস্থাই সংকটজনক।'
তিনি ঝুঁকি কমাতে বয়স্ক রোগী, একাধিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও সন্তানসম্ভবা নারীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। পাশাপাশি সতর্ক করেন, ডেঙ্গুর ভিন্ন সেরোটাইপে পুনঃসংক্রমণ হলে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে চিকিৎসায় দেরি হলে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বাধিক মৃত্যু হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডা. নাজমুল আহসান বলেন, 'ঢাকার বাইরে থেকে অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে ঢাকায় রেফার করা হয়। অনেকে ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুবরণ করেন ঢাকার হাসপাতালেই। দেরিতে রেফার করাও বড় একটি কারণ।'
তিনি বলেন, 'বরিশাল বা অন্য কোনো জেলা থেকে ঢাকায় আসতে কয়েক ঘণ্টা লাগে। আবার ভর্তি হতে আরও সময় যায়। যদি রোগী ইতোমধ্যেই শকে থাকেন, তাহলে এই দেরি প্রাণঘাতী হতে পারে।'
তিনি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে জাতীয় ডেঙ্গু চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্থানীয়ভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানান। বলেন, 'শুধু গুরুতর অবস্থার রোগীদেরই ঢাকায় পাঠানো উচিত। কিন্তু প্রায়ই ভয়ের কারণে রোগীকে আগেই রেফার করা হয়।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'শকে থাকা রোগীকে স্থিতিশীল করার পরই ঢাকায় পাঠানো উচিত। দুর্ভাগ্যবশত অনেক হাসপাতাল এটা করে না। ফলে রোগীরা মারাত্মক শক নিয়েই ঢাকায় পৌঁছান, যা মৃত্যুঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে।'
প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা বাড়ানোর আহ্বান
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মুশতাক হোসেনও আগেভাগে চিকিৎসা শুরু ও স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বয়স্ক রোগী, শিশু ও একাধিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।
তিনি মানুষকে সিটি করপোরেশনের দেওয়া বিনামূল্যের ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা গ্রহণে উৎসাহিত করতে সচেতনতা কার্যক্রম জোরদারের আহ্বান জানান। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে রক্ত সংগ্রহকেন্দ্র ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের সুপারিশ করেন।
মুশতাক সারা বছরব্যাপী স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানোর ওপর জোর দেন, যাতে মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
Comments