কোন পথে যেতে চায় নেপাল

নেপালে বিক্ষোভ
কাঠমান্ডুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ জনতা। ছবি: রয়টার্স

কোনো শাসনব্যবস্থাই যেন খাপ খাচ্ছে না নেপালিদের সঙ্গে। মূল সমস্যা দুর্নীতি। সঙ্গে যোগ হয়েছে দারিদ্র। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেপালের আছে 'হিমালয় কন্যা'র খ্যাতি। কিন্তু, বেকারত্ব সবকিছু ম্লান করে দিয়েছে।

ভূবেষ্টিত নেপাল বিশ্বমঞ্চে গরিব দেশ হিসেবেই বিবেচিত। চলতি বছর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে 'নেপালে চরম দারিদ্র প্রায় বিলুপ্ত'। তবে এমন সুসংবাদ এসেছে রেমিট্যান্সের কল্যাণে। অর্থাৎ, নেপালিরা নিজ দেশে কাজ পাচ্ছেন না। তাদেরকে ছুটতে হচ্ছে দূরের দেশে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে নেপালের সংকট হিসেবে তরুণদের মধ্যে উচ্চহারে বেকারত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজে বৈষম্যের কথাও বলা হয়েছে। আর এসব সংকট দেশটির আর সব সাফল্যকে 'উল্টে' দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছিল সংস্থাটির প্রতিবেদনে।

গত বছর প্রকাশিত নেপালের সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০২২-২৩ সালে দেশটির ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।

এসব হলো খাতা-কলমের কথা। বাস্তবতা হলো নেপালের মানুষ তাদের শাসকদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই গত ১৭ বছরে দেশটিতে সরকার বদলেছে ১৩ বার। কোনো সরকারই জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারেনি। বিশ্ববাসী দেখলো নেপালিদের সব ক্ষোভ ঝরে পড়ছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো ওপর। যে পার্লামেন্ট ভবনকে গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই ভবনও জ্বালিয়ে দিলো জনতা।

এখন প্রশ্ন—আসলে কোন পথে যেতে চায় নেপাল?

ইতিহাস থেকে জানা যায়—১৯৫০ এর দশক থেকেই নেপালে চলছে রাজনৈতিক টানাপড়েন। সেসময় গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে হাঁটতে শুরু করেছিল দেশটি। তখন রাজা ছিলেন মহেন্দ্র। ১৯৫৫ সালে বাবা ত্রিভুবনের মৃত্যুর পর মহেন্দ্র রাজপাট গ্রহণ করেন। পরের দশকে নেপালকে দেখা যায় সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের চর্চা করতে।

১৯৭২ সালে রাজা মহেন্দ্রের মৃত্যুর পর শাসনদণ্ড নেন ছেলে বীরেন্দ্র। চেষ্টা করেন উত্তরের শক্তিশালী প্রতিবেশী চীন ও দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারতের প্রভাবমুক্ত থেকে দেশ চালানোর।

নেপালে বিক্ষোভ
বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ছে নেপালের পার্লামেন্ট ভবন। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

পরে, ১৯৮০ এর দশকে নেপালে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে শুরু করে। কিন্তু, ১৯৯০ সালে আরও গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু হয় গণআন্দোলন। পুলিশ ও সেনা নামিয়ে তা দমনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু, জনদাবির কাছে নতি স্বীকার করে রাজা বীরেন্দ্র সেই বছর দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পথ খুলে দেন। নিজে হোন রাষ্ট্রপ্রধান। গুরুত্ব দেওয়া হয় মানবাধিকার ও ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর।

কিন্তু, তাতেও পুরোপুরি প্রতিপলিত হয়নি আমজনতার আশা-প্রত্যাশার। ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী)। নেতা হন পুষ্প কমল দহাল ওরফে প্রচণ্ড। তার নেতৃত্বে নেপালিদের একাংশ জড়িয়ে পড়েন গৃহযুদ্ধে। উদ্দেশ্য ছিল ১৭৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি। সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন।

নেতা প্রচণ্ডের নেতৃত্বে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র বা রাজা নিয়ন্ত্রিত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা উৎখাতের লক্ষ্যে মাওবাদীরা শুরু করেন 'জনযুদ্ধ'। ডাক দেন একদলীয় কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের। প্রায় এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারান ১৭ হাজারের বেশি মানুষ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাবে তা ১৩ হাজার।

২০০১ সালের ১ জুন শান্ত-সুন্দর এই দেশটির জাতীয় জীবনে ঘটে যায় চরম বিয়োগান্তক ঘটনা। যুবরাজ দীপেন্দ্রের হাতে নিহত হন রাজা-রানিসহ রাজপরিবারের সদস্যরা। এরপর নিজেকে হত্যা করেন দীপেন্দ্র।

এই হত্যাকাণ্ডে কার হাত ছিল বা কোন বিদেশি শক্তির ইশারায় এমনটি হয়েছে—তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। শত জল্পনার জাল ছিঁড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন বীরেন্দ্রের ভাই জ্ঞানেন্দ্র। তিনি মাওবাদীদের শক্ত হাতে দমন করার অঙ্গীকার নিয়ে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।

নেপালে বিক্ষোভ
কাঠমান্ডুতে সেনা চেকপোস্ট। ছবি: এএফপি

নেপালবাসী দেখেন জ্ঞানেন্দ্র সব ক্ষমতার মালিক হলেও তিনি গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে পারেননি। ২০০৫ সালের নভেম্বরে মাওবাদীরা দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে রাজতন্ত্রবিরোধী জোট গঠন করে। পরের বছর দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। সেসময় প্রধানমন্ত্রী হন বর্ষীয়ান রাজনীতিক গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। তখন মাওবাদীদের সঙ্গে নিয়ে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

২০০৬ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী কৈরালা ও বিদ্রোহীপ্রধান প্রচণ্ড শান্তিচুক্তি করলে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। আশা করা হয়েছিল, শান্তি ফিরবে হিমালয়ের শান্ত কোলে। কিন্তু, বিধি বাম! নেপালবাসীর কাছে শান্তি অধরাই থেকে গেল।

২০০৮ সালের ২৮ মে নেপাল ২০০ বছরের বেশি পুরোনো রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হয়। এক সময়ের হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল হয় ধর্মনিরপেক্ষ। তাতেও সুখ ফেরেনি নেপালবাসীর ভাগ্যে।

২০০৮ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নেপালে আসে ১৩টি সরকার। কোনো সরকারই দেশবাসীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। দারিদ্র-দুর্নীতির বোঝা এতই বেড়েছে যে সেই ক্ষোভ আবারও আছড়ে পড়তে দেখা গেল কাঠমান্ডুর রাজপথে।

গত সোম ও মঙ্গলবারের সহিংস আন্দোলনে নেপালে আবারও পতন হলো সরকারের। মূলত দুর্নীতির অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। তবে, রাজতন্ত্রবিরোধী সরকারের পতনে খুশি রাজা জ্ঞানেন্দ্রভক্তদের অনেকে। যদি তিনি রাজ ক্ষমতায় ফিরে আসেন তাহলে নেপাল হয়ত আবার হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে।

গত ১৭ বছরে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা ও সবার জন্য সুদিন ফিরিয়ে আনার আশায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের ক্রমাগত ব্যর্থ প্রচেষ্টা কি আবারও নেপালে প্রাচীন রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকেই ফিরিয়ে আনবে?

এ দিকে, বর্তমানে অশান্ত নেপালের দায়িত্ব গিয়েছে সেনাদের হাতে। জারি করা হয়েছে কারফিউ। সেনা শাসনবিরোধীরা যদি এর বিরোধিতা করেন তাহলে কি আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পথে যাবে দেশটি?

সব মিলিয়ে আবারও সেই প্রশ্ন—আসলে কোন পথে যেতে চায় নেপাল?

Comments

The Daily Star  | English

Dozens of zombie firms still trading as if nothing is wrong

Nearly four dozen companies have been languishing in the junk category of the Dhaka Stock Exchange (DSE) for at least five years, yet their shares continue to trade on the country’s main market and sometimes even appear among the top gainers. 

1h ago