চলে গেলেন সাড়া জাগানো ফরাসি অভিনেত্রী ব্রিজিত বার্দো
ফরাসি চলচ্চিত্রের সাড়া জাগানো অভিনেত্রী ও স্বনামধন্য গায়িকা ব্রিজিত বার্দো (৯১) মারা গেছেন।
আজ রোববার এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি ও যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান।
৫০ ও ৬০ এর দশকে ব্রিজিত অভিনীত সিনেমাগুলো জনপ্রিয়তা পায়। যার ফলে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান।
সিনেমার রূপালী জগৎ ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি প্রাণী অধিকার আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তবে জীবনের পরবর্তী সময়ে তার কট্টর ডানপন্থি রাজনৈতিক অবস্থান হয়ে ওঠে ক্রমেই বিতর্কিত।
বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী বার্দো
ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার সেইন্ট-ট্রোপাজ শহরে নিজ বাড়িতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ব্রিজিত। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি 'লা মাদ্রাগ' নামের বাড়িতে অতিবাহিত করেন।
ব্রিজিত বার্দো ফাউন্ডেশন এক বিবৃতিতে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, ব্রিজিত চলচ্চিত্রে তার সম্মানজনক ক্যারিয়ার ছেড়ে প্রাণীদের কল্যাণে ও নিজের ফাউন্ডেশনের প্রতি জীবন উৎসর্গ করেছেন।
বিবৃতিতে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। অক্টোবরে তিনি অল্প কয়েকদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সে সময় ইন্টারনেটে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে ব্রিজিত 'নির্বোধ ইন্টারনেট ইউজারদের' একহাত নেন।
নিজ দেশে 'বিবি' নামে পরিচিত ব্রিজিত বার্দোর মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ সহ অনেকেই শোক জানিয়েছেন।
মাখোঁ তাকে বিংশ শতাব্দীর 'কিংবদন্তি' আখ্যা দেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ব্রিজিত
ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তার বাণীতে ব্রিজিতকে প্রশংসায় ভাসান। তবে তিনি ব্রিজিতের কট্টর ডানপন্থি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনাও মন্তব্য করেননি।
অভিনয় পরবর্তী জীবনে ব্রিজিতের অনেক ভক্ত তার এই রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার কারণে তার থেকে দূরে সরে যান।
ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য রাখার অভিযোগে পাঁচবার অভিযুক্ত হয়েছেন ব্রিজিত। এর বেশিরভাগই মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেওয়া বক্তব্য।
পাশাপাশি তিনি ফরাসি দ্বীপ 'রিইউনিয়নের' বাসিন্দাদেরও সমালোচনা করেন। তাদেরকে 'বর্বর' আখ্যা দেন।
২০০৩ সালে প্রকাশিত বই 'আ ক্রাই ইন দ্য সাইলেন্স'–এ ডানপন্থী রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নেন বার্দো। সেখানে তিনি সমকামী নারী-পুরুষ, শিক্ষক সমাজ এবং তথাকথিত 'ফরাসি সমাজের ইসলামায়ন'–এর বিরুদ্ধে তীব্র ভাষা ব্যবহার করেন। এর ফলেও তাকে বর্ণবিদ্বেষে উসকানির দায়ে দণ্ডিত হতে হয়।
তিনি উল্লেখ করেন, 'আমাদের পূর্বসূরি, বাবা-দাদারা শতাব্দীর পর শতাব্দী, একের পর এক আগ্রাসীর মোকাবিলায় জীবন দান করেছেন।'
ক্যারিয়ারের শুরু
১৯৩৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসের একটি সম্ভ্রান্ত ক্যাথলিক পরিবারের জন্ম নেন ব্রিজিত। নাচে অসাধারণ দক্ষতার কারণে তিনি প্যারিসের মর্যাদাপূর্ণ কনজারভাতোয়ার দ্য প্যারিসে ব্যালে পড়ার সুযোগ পান।
১৯৫৬ সালে 'অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান' সিনেমায় অভিনয় করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনে পরিচিতি পান ব্রিজিত। ১৯৭৩ সালে অবসর নেওয়ার আগে আরও প্রায় ৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।
একই সময়ে মডেল হিসেবেও কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ফরাসি সাময়িকী এল–এর প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন ব্রিজিত।
এই মডেলিং কাজের সূত্রেই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান ব্রিজিত।
একটি সিনেমার অডিশনে ব্রিজিতের সঙ্গে রজার ভাদিমের পরিচয় হয় । ১৯৫২ সালে তারা বিয়ে করেন। সে সময় ব্রিজিতের বয়স ছিল ১৮।
সিনেমার ব্রিজিত
শুরুর দিকে ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেতে থাকেন ব্রিজিত। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাজ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ছবি 'ডক্টর অ্যাট সি'–তে ডার্ক বোগার্ডের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি।
তবে ব্রিজিতের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ভাদিম পরিচালিত 'অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান'। এক অবাধ্য কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করে তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক তারকা। ছবিটি ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সাফল্য পায় এবং বার্দোকে ফরাসি চলচ্চিত্রের প্রথম সারির তারকাদের কাতারে তুলে আনে।
প্রেরণার নাম ব্রিজিত বার্দো
শুধু সিনেমাপ্রেমী নয়। খুব দ্রুত তিনি চিন্তাবিদ ও শিল্পীদের প্রেরণার উৎসে পরিণত হন। ৬০ এর দশকের তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড দ্য বিটলসের দুই তরুণ সদস্য জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনি তাদের তৎকালীন বান্ধবীদের চুল ব্রিজিতের আদলে সোনালি রং করতে বলেছিলেন বলে জানা যায়।
১৯৫৮ সালে প্যারিস-ম্যাচ সাময়িকীতে কলামিস্ট রেমন্ড কার্টিয়ে লেখেন দীর্ঘ নিবন্ধ—'লে কা বার্দো'।
১৯৫৯ সালে দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ 'ব্রিজিত বার্দো অ্যান দ্য লোলিতা সিনড্রোম'।
যেখানে বার্দোকে ফ্রান্সের সবচেয়ে মুক্তমনা নারী হিসেবে চিত্রিত করেন বোভোয়ার।
১৯৬৯ সালে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রতীক মারিয়ানের প্রথম জীবিত মডেল হিসেবে বেছে নেওয়া হয় তাঁকে।
একের পর এক সফল সিনেমা
ষাটের দশকের শুরুতে বার্দো অভিনয় করেন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি ছবিতে—হেনরি-জর্জ ক্লুজোর অস্কার মনোনীত ছবি 'দ্য ট্রুথ', লুই মাল পরিচালিত 'ভেরি প্রাইভেট অ্যাফেয়ার' এবং জঁ-লুক গোদারের 'কনটেম্পট'। দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি হলিউডের দিকেও পা বাড়ান। এ সময় তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে 'ভিভা মারিয়া!' এবং শন কনারির বিপরীতে ওয়েস্টার্ন ছবি 'শালাকো'।
তারকাখ্যাতির চাপ
তারকাখ্যাতির চাপ বার্দোর কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল। ১৯৯৬ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমাকে ঘিরে যে উন্মাদনা ছিল, তা সব সময়ই অবাস্তব মনে হতো। তারকা–জীবনের জন্য আমি কখনোই পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম না।'
১৯৭৩ সালে, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, 'দ্য এডিফাইং অ্যান্ড জয়াস স্টোরি অব কলিনো' ছবির পর অভিনয় থেকে অবসর নেন তিনি।
সিনেমা পরবর্তী জীবন
রুপালি জগৎ ছেড়ে তিনি মূলত মনোযোগ দেন প্রাণী সুরক্ষা আন্দোলনে।
১৯৭৭ সালে সিল মাছ শিকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন এবং ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিজিত বার্দো ফাউন্ডেশন।
রোমানিয়ায় কুকুর নিধন, ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জে ডলফিন হত্যা, অস্ট্রেলিয়ায় বিড়াল নিধনের বিরুদ্ধে তিনি বিশ্বনেতাদের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠান। ধর্মীয় আচার অনুযায়ী পশু জবাই নিয়েও তিনি নিয়মিত বিতর্কিত মন্তব্য করেন।
বার্দো চারবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন—রজার ভাদিমের সঙ্গে (১৯৫২–১৯৫৭), জাক শারিয়েরের সঙ্গে (১৯৫৯–১৯৬২); গুন্টার স্যাক্সের সঙ্গে (১৯৬৬–১৯৬৯) এবং ১৯৯২ সালে সাবেক লে পেন উপদেষ্টা বার্নার দ'ওরমালের সঙ্গে। এ ছাড়া জঁ-লুই ত্রিনতিনিয়াঁ ও সের্জসহ একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি।
১৯৬০ সালে দ্বিতীয় স্বামী জাঁক শারিয়েরের ঘরে তার একমাত্র সন্তান নিকোলাস জন্ম নেন।


Comments