নাইটহুড কী, কারা পান, কীভাবে দেওয়া হয়
যুক্তরাজ্যের রাজ পরিবার থেকে দেওয়া অন্যতম শীর্ষ সম্মাননা 'নাইটহুড'। সাধারণত যারা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ে, সেসব ব্যক্তিকে এটি দেওয়া হয়। আর নারীদের খেতাবকে বলা হয় 'ডেমহুড'।
একটা সময় প্রধানত সামরিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এই খেতাব দেওয়া হতো। 'নাইট' শব্দের অর্থ 'ঘোড়সওয়ার', মধ্যযুগে নাইটদের ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, যাতে তারা সাহসী ও মার্জিত হয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে পারেন।
তবে এই ধারা এখন বদলেছে। জাতীয় জীবনে নানা ক্ষেত্রে অনন্য সব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয় এই খেতাব।
ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পী, স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে ফুটবল কোচ, এমনকি শিল্পপতিরাও পেয়েছেন এই খেতাব।
ক্রিকেটারদের মধ্যে অ্যালিস্টার কুক, জেমস অ্যান্ডারসনরা এই খেতাব পেয়েছেন। কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।
এ ছাড়া যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে এই খেতাব পেয়েছেন জনপ্রিয় মুভিস্টার অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
বিশ্বকবি হিসেবে সমাদৃত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পেয়েছিলেন এই খেতাব। কিন্তু পরে তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯১৫ সালে 'নাইটহুড' পেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এই খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ওয়েবসাইট রয়্যাল ডট কম বলছে, এই খেতাব বিক্রিযোগ্য নয়।
খেতাবটি দেওয়া হয় রাজা বা রাজপরিবারের একজন সদস্যের মাধ্যমে, যিনি রাজা বা রানির পক্ষে দায়িত্ব পালন করেন। এটি হতে পারে সরকারি অনুষ্ঠানে বা ব্যক্তিগতভাবে। অনুষ্ঠানে প্রার্থী বিশেষভাবে দাঁড়িয়ে বা হাঁটু গেড়ে বসেন। রাজা বা রাজপরিবারের সদস্য একটি বিশেষ চেয়ারে বসে প্রার্থীর ডান কাঁধে, তারপর বাম কাঁধে খোলা তলোয়ার স্পর্শ করেন।
এরপর নাইট বা ডেমকে তাদের সম্মানসূচক পদচিহ্ন দেওয়া হয়। নারীদের ক্ষেত্রে এই তলোয়ার স্পর্শ করা হয় না।
সম্প্রতি খেতাবপ্রাপ্ত
সম্প্রতি এই খেতাব পেয়েছেন ডেভিড বেকহ্যাম, যিনি এখন মহাতারকা ফুটবলার লিওনেল মেসির ক্লাব 'ইন্টার মায়ামি'র মালিক।
ইংল্যান্ড ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক বেকহ্যামকে ফুটবল ও ব্রিটিশ সমাজের সেবার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নাইট খেতাব দেওয়া হয়।
বেকহ্যাম ইংল্যান্ডের হয়ে ১১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন, ৫৯ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন। তাকে ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকা মনে করা হয়।
ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সময় তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন।
৫০ বছর বয়সী বেকহ্যামকে এ বছর রাজা চার্লসের জন্মদিনের সম্মাননার তালিকায় রাখা হয়েছিল।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বার্কশায়ারের এক অনুষ্ঠানে রাজা তাকে এই খেতাব প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানে বেকহ্যাম বলেন, 'আমি গর্বিত হওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দিত। সবাই জানে আমি কতটা দেশপ্রেমিক, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি।'
এই আয়োজনে বেকহ্যামের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম এবং বাবা-মা স্যান্ড্রা ও ডেভিড।
উইন্ডসর ক্যাসলে বেকহ্যাম যে পোশাকটি পরেছিলেন, তা তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম ডিজাইন ও তৈরি করেছিলেন।
ভিক্টোরিয়া ২০১৭ সালে ফ্যাশন শিল্পে অবদানের জন্য অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন ফজলে হাসান আবেদকে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সুবিধাবঞ্চিতদের ক্ষমতায়নে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে 'নাইট' খেতাব দেওয়া হয়েছিল।
খেতাবের প্রক্রিয়া
নতুন বছরের উদযাপনে ও ব্রিটিশ রাজার জন্মদিনে এই খেতাব দেওয়া হয়ে থাকে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা সুপারিশ দেন। সাধারণ মানুষও কাউকে এই ধরনের সম্মাননার জন্য সুপারিশ করতে পারেন।
মোট সম্মাননার চার ভাগের এক ভাগ সাধারণ সুপারিশে হয়ে থাকে।
সম্মাননার তালিকায় সাধারণত সেই ব্যক্তিদের নাম থাকে যারা জনজীবনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন এবং ব্রিটেনের সেবা ও কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
ফরেন ও কমনওয়েলথ সংক্রান্ত দায়িত্বে বিদেশি নাগরিকদের জন্য সম্মাননার সুপারিশ করে থাকেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সরকারি ঘোষণা আসার আগে খেতাবপ্রাপ্তদের নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হয়। সাধারণত সম্মাননা রাজা, প্রিন্স অব ওয়েলস বা প্রিন্সেস রয়াল প্রদান করেন। অনুষ্ঠান হয় বাকিংহাম প্রাসাদ, উইন্ডসর ক্যাসল বা প্যালেস অব হলিরুডহাউসে।
প্রাপকরা অনুষ্ঠানের তারিখ ও স্থান নির্বাচন করতে পারেন, তবে কোন রাজপরিবারের সদস্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন, তা তারা ঠিক করতে পারেন না।
ব্রিটিশ সম্রাজ্যের এই খেতাব স্থানীয়ভাবে লর্ড-লেফটেন্যান্টদের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তারা রাজার প্রতিনিধি হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করেন।

Comments