ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি হামাসের পুরস্কার নয়

পশ্চিমা গণমাধ্যম যেভাবে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা আড়াল করে
উত্তর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণের দিকে যাচ্ছে। কারণ ইসরায়েলি সেনারা গাজা শহরের বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। ঠিক তখনই মধ্য গাজায় ইসরায়েলি হামলার ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ বেশকিছু পশ্চিমা শক্তি অবশেষে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি এত দেরিতে আসায় অনেকেই মনে করেন, গাজায় হাজারো মৃত্যুর দায় এই দেশগুলোর ওপরও বর্তায়, বিশেষ করে যখন এই মৃত্যুগুলো ঠেকানো যেত। তারপরও পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো হামাসকে পুরস্কৃত করা। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেছেন, 'সত্যি বলতে, তিনি (ট্রাম্প) মনে করেন, এটা হামাসের জন্য পুরস্কার।'

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বক্তৃতার সময় ট্রাম্প আবারও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর বিষয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলেছেন। গাজাকে 'মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা' বানানোর প্রস্তাব দেওয়া ট্রাম্পের পাশাপাশি, আশ্চর্যজনকভাবে ব্রিটেনের বেশকিছু প্রভাবশালী গণমাধ্যমও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সুরেই বলছে, এটা নাকি সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ।

ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনামগুলো ছিল একেবারেই হতবাক করার মতো এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে অবমাননার জলজ্যান্ত উদাহরণ। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ঘোষণার পরদিন ডেইলি মেইল বড় করে ছাপিয়েছে—হামাসের বিজয় দাবি। দ্য টাইমসও একই পথে হেঁটেছে। ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারকে উদ্ধৃত করে বলেছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নাকি হামাসকে 'সবচেয়ে বড় পুরস্কার' দিয়ে দিয়েছেন। টেলিগ্রাফও একইভাবে শিরোনাম করেছে—ফিলিস্তিনকে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির পর হামাসের বিজয় ঘোষণা।

কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। তেমন উদাহরণ যারা তৈরি করেছে, তারা উদারপন্থী ও বামঘেঁষা হিসেবেই পরিচিত। দ্য মিররের প্রথম পাতায় গাজায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে—শান্তির সর্বোচ্চ প্রত্যাশা। দ্য গার্ডিয়ান উদ্ধৃত করেছে স্টারমারের সেই বক্তব্য যেখানে তিনি বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত 'দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতি'।

কিন্তু সামগ্রিক সুর ছিল ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী।

অনেক দিন ধরেই অভিযোগ আছে, পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম ফিলিস্তিনিদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের উদ্যোগে গঠিত সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং দেখিয়েছে, বিবিসির উপস্থাপকরা অন্তত ১০০ বার গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ নেতানিয়াহুর 'আমালেক' প্রসঙ্গসহ ইসরায়েলি নেতাদের প্রকাশ্য গণহত্যার বক্তব্য কখনোই উল্লেখ করেননি।

গত জুনে সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৫ হাজারের বেশি বিবিসি কনটেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরায়েলিদের মৃত্যুকে ৩৩ গুণ বেশি কাভারেজ দেওয়া হয়েছে এবং চার গুণ বেশি আবেগপূর্ণ ভাষায় ইসরায়েলিদের মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাতটি ও আন্তর্জাতিক তিনটি টেলিভিশনের এক লাখ ৮০ হাজার ভিডিও ক্লিপ, ২৮টি ব্রিটিশ গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট থেকে ২৬ হাজার সংবাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেও ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের একই ধারা দেখতে পাওয়া যায়। যদিও বিবিসি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, 'আমরা মনে করি না যে শব্দ গণনা করে যথাযথ নিরপেক্ষতা পরিমাপ করা যেতে পারে। আমরা আমাদের নিজস্ব স্বাধীন সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত নিই এবং এর বাইরের যেকোনো পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করি।'

এটা কেবল ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগকে ছোট করে দেখা নয়, বরং প্রায় দুই বছর ধরে বিরামহীনভাবে চলা ইসরায়েলি নিপীড়ন ও যুদ্ধাপরাধকে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা। বাইরের কোনো সাংবাদিক ঢুকতে না পারলেও গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা পুরো দুনিয়া সরাসরি দেখতে পারছে। আল জাজিরাকে গাজায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি, বিদেশি সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, আর স্থানীয় সাংবাদিকদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘ বলছে, গাজায় এই অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে যত সাংবাদিক নিহত হয়েছে, তা দুই বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানের সব যুদ্ধ মিলে নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সাংবাদিক নিহতের সংখ্যা ২২০ থেকে ২৭২ জনের মধ্যে। অথচ পশ্চিমা গণমাধ্যমে তাদের আত্মত্যাগের এই খবর খুব কমই এসেছে। কারণ, তারা গাজা যুদ্ধ কভার করার সময়, নারী ও শিশুসহ নিরীহ মানুষের অমানবিক দুর্ভোগের কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। তাই তাদের মৃত্যুর সংবাদের পরিবর্তে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্রের ব্রিফিং পশ্চিমা গণমাধ্যমের কভারেজে প্রাধান্য পেয়েছে।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো একই কাজ করছে, যা তারা গাজায় ইসরায়েলি অমানবিক আগ্রাসনের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে করে, হামাসের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে একই কাতারে ফেলছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ ও নৃশংসতাকে দেখানো হয় স্বাভাবিক হিসেবে। রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ইউক্রেনীয়দের পরিস্থিতি মানবিক ভাষায় উপস্থাপন করা হলেও, ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

নিঃসন্দেহে পশ্চিমা দেশগুলোর ফিলিস্তিনকে দেওয়া এই স্বীকৃতি কেবল প্রতীকী। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলের পক্ষেই দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেছেন, কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে না। সেই প্রেক্ষিতে এই প্রতীকী উদ্যোগও 'দুই রাষ্ট্র' সমাধানের আশা টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরি।

এখন এই স্বীকৃতিকে বাস্তব রূপ দিতে গাজা যুদ্ধ বন্ধ ও পশ্চিম তীর দখল রোধ করা প্রয়োজন। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের জন্য আলোচনা পুনরায় শুরু করতে, ইসরায়েলি জিম্মি ও ইসরায়েলি কারাগারে আটক বেসামরিক নাগরিকদের মুক্তি দিতে এবং গাজা পুনর্নির্মাণ করতে অবিলম্বে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ ও সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে।


কামাল আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারের কনসাল্টিং এডিটর। তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার এক্স হ্যান্ডেল: @ahmedka1


 

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

2h ago