শেষ বক্তব্যে যে আক্ষেপ করেছিলেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
শিক্ষা খাতে বিপ্লব ঘটাতে পারে এমন সিদ্ধান্তের দিকে যেতে পারতো বাংলাদেশ। অথচ তা হয়নি। শেষ বক্তব্যে এই আক্ষেপ করেছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'কেউ শোনেননি কথা। আমি বহুদিন থেকে লেখালেখি করছি। কেউ একটা কথাও শোনেননি।'
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে আবু খালেদ পাঠান সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন এই শিক্ষাবিদ।
'আবু খালেদ পাঠান ফাউন্ডেশন' এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল।
এটি ছিল কোনো অনুষ্ঠানে তার শেষ অংশগ্রহণ। গত ৩ অক্টোবর সকালে তাকে রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে সময় চিকিৎসক জানান, তার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
২৭ সেপ্টেম্বরের ওই আয়োজনে আশির দশকের এক নাট্যকারের স্মৃতিচারণ করে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, কেমন আছেন? বলতেন, ভালো থাকার হুকুম আছে। তো আমাকেও বলতে হয় যে, আশাবাদ ধরে রাখার হুকুম আছে। হুকুমটা কারা করছে? আমার ছাত্র-ছাত্রীরা। আমার প্রতিদিনের সংসার কাটে ১৮ থেকে ২৪-২৫ বছরের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। কাজেই আমার ভেতর বার্ধক্য কোনোদিন আসবে না। যদিও আমার বার্ধক্য উপনীত, আমার বয়স—বার্ধক্যেরও গভীরে চলে গেছি। কিন্তু আমার ভেতর বার্ধক্য আসতে পারে না। কারণ ছেলে-মেয়েরা আমাকে সতেজ রাখে। তারা আমাকে আশাবাদ ধরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করে।'
তিনি বলেন, 'আশাবাদ একটা মোমবাতির মতো। একটা মোমবাতি হাতে থাকলেই হয়। একটা মোমবাতি থেকে অনেকগুলো মোমবাতিতে আলো প্রজ্বলন করা যায়। তো যার হাতে আশাবাদের একটা মোমবাতি আছে, তার পক্ষে গোটা দেশকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। তবে তার জন্য অনেক কাজ বাকি আছে। শিক্ষাটায় আমাদের নজর দিতে হবে। যেটা আবু খালেদ পাঠান হয়তো সমস্ত জীবন চেষ্টা করেছেন। সেই মাপের শিক্ষকও এখন নেই। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করা যায় না। এটি একেবারে আমার পরীক্ষিত একটা চিন্তা।'
'শিক্ষককে ভালো হতে হবে। শিক্ষককে মেধাবী হতে হবে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা কত বেতন পান? সংস্কার তো ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে। মৌলিক বিষয়গুলো তো আপনাকে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি জানান, তাদের দাবিগুলো মিটে যায়। এখনো দেখছি, বেতন বাড়ানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুব আনন্দ পাচ্ছেন। তাদেরও বেতন বাড়বে। বেতন তো বাড়া উচিত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের! এই বর্তমান বাজারে তাদের যদি দেওয়া হয় এক লক্ষ টাকা করে মাসে, তাদের থাকার জায়গা দেওয়া হয় মানসম্পন্ন। বিসিএস পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার চাইতে এই মেধাবীরা এসে প্রাইমারি স্কুলে এসে ঢুকবে। আপনি ভাবুন, কত বড় একটা বিপ্লব হতে পারে শিক্ষার ক্ষেত্রে! কেউ শোনেননি কথা। আমি বহুদিন থেকে লেখালেখি করছি। কেউ একটা কথাও শোনেননি। সংস্কার হবে কী করে? যারা সংস্কার করবেন তাদেরও তো শিক্ষার অভাব আছে,' বলেন তিনি।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'দেখুন শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে, সংস্কৃতির একটা শিক্ষা আছে। দুটো মেলে না। যেসব দেশে দুটো মিলে গেছে, সেসব দেশে উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার সংস্কৃতিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটা আলোকিত করে মানুষকে। আর সংস্কৃতির শিক্ষা হচ্ছে সবাইকে সবার সঙ্গে যুক্ত করা। এই প্রাণের সঙ্গে প্রাণ যুক্ত না হলে, মনের সঙ্গে মনের মিল না হলে সমাজে কলহ থাকে, সমাজে অসূয়া থাকে, নিন্দাবাদ চলতেই থাকে, এবং এক সময় সেটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো আমরা সবাই পাই। তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতরে সংস্কৃতিটা কোথায় আমাদের? আলো জ্বালার সংস্কৃতি মনের ভেতর, জানার, একটা কৌতূহলের, উৎসাহের?'
রেনেসাঁর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গে উনিশ শতকে সেটি ঘটেছে কিন্তু খুব ছোট পরিসরে। সেই রেনেসাঁ দেশকে জাগায়নি, একটা সম্প্রদায়কে জাগিয়েছে শুধু। অথচ মধ্যযুগে আলাওল লিখেছেন পদ্মাবতী। রেনেসাঁ এখানে, এই পূর্ববঙ্গে ঘটেছিল যখন আলাওল পদ্মাবতী লিখছেন, সেটি সবচেয়ে বড় রেনেসাঁর ঘটনা। কারণ নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, অন্য সম্প্রদায়ের চিন্তাকে গ্রহণ করা, উনিশ শতকের কলকাতার সম্প্রদায়ে সেটি ছিল না। এটি ছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, যার অনেক স্রষ্টা ছিলেন মুসলমান, যারা নিজেদের ভাষা নিয়ে ভেবেছেন, ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতি নিয়ে ভেবেছেন, উত্তরাধিকার নিয়ে ভেবেছেন, লোকায়ত চিন্তা এবং প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাবার কথা বলছেন।'
'ওখানেই তো আমাদের রেনেসাঁর বীজ রোপিত ছিল। সেই সেখান থেকে আমাদের মহীরুহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল এতদিনে। হয়নি, কারণ শিক্ষাকে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ একটা খাত হিসেবে তৈরি করা এবং ভৌত কাঠামো তৈরির উন্নয়নের যে সমস্ত কাঠামো আমরা দেখি চারদিকে, সেগুলোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
শিক্ষক জীবনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'আমাকে একবার বলা হয়েছিল যে, আমাদের ডিজিটাল ক্লাসরুম হবে। আমি বললাম, হ্যাঁ, ডিজিটাল ক্লাসরুম হবে কিন্তু ডিজিটাল মনটা কোথায়? ক্লাসরুম চালাবার মতো ডিজিটাল মনটা কোথায়? যে মনটার ভেতরে ওই বাইনারিটা কাজ করবে—শূন্য আর এক; যারা ডিজিটাল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তার ভেতরে অনন্ত যে একটা সম্পর্ক বিদ্যমান, দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, তার থেকে অনেক জ্ঞান তৈরি হয়। যেটাকে পরে আমরা ডায়লেক্টিক বলি। সেই বিষয়গুলো যদি আমাদের ভেতর না থাকে, শুভের সঙ্গে অশুভের দ্বন্দ্বে কখন অশুভ জিতে যায়, সেই বিষয়ে যদি আমরা কোনো আগ্রহ না দেখাই, তাহলে তো মুশকিল!'
এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দ্বন্দ্বমান সমাজে সব সময় পক্ষ-প্রতিপক্ষ থাকে। পক্ষের দিকে যদি আমরা থাকি, যেখানে শুভ আছে, সুন্দর আছে, কল্যাণ আছে, তাহলে বাকিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা তো ওইদিকে চলে যাই। আমরা অকল্যাণ দেখলেই দৌড়ে পড়ি। অশুভ দেখলেই আমাদের আনন্দ হয়। বীভৎসতা-সহিংসতা আমাদের এত বেশি তৃপ্তি দেয়! একজন নিরীহ মানুষকে ধরে আমরা যেকোনো ধরনের অন্যায় করতে পারি তার সঙ্গে। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি। একজন নারীর নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে কখনো দেবো না। তাদেরকে সব সময় একদম এক ধরনের মোরাল পুলিশিংয়ের ভেতর রাখব।'
'এই সমস্ত মুক্ত চিন্তা করতে জানে না। আর মুক্ত চিন্তা যদি করতে না জানি, নিজের ভেতর যদি বিতর্ক না করতে পারি নিজের সঙ্গে নিজের বিতর্কটাই তো আমাদের চলে না কখনো! আমাদের বিতর্ক থাকে না, শুধু তর্ক হয়। যতীন সরকার, যিনি সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন, তিনিও একটা জেলা শহরে নিজের স্থায়ী কাঠামো গড়ে মানুষকে আবু খালেদ পাঠানের মতো মনস্যতা এবং সৃষ্টিশীলতার দিকে আগ্রহী করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি সব সময় বলতেন যে, "আমরা তো শুধু পরীক্ষার্থী তৈরি করলাম, কোনো শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারিনি।" কথাটা খেয়াল করে দেখুন, আমরা সবাই পরীক্ষার জন্য ব্যগ্র। বিসিএস পরীক্ষা জীবনের সবচেয়ে বড় একটা আনন্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় লাইব্রেরির সামনে সকাল ৭টার সময় বিশাল লাইন পড়ে যেত। ব্যাগ রাখা হলো অনেকটা ইট রাখার মতো, কোথায়? এত ছেলে-মেয়ে লাইব্রেরিতে যাচ্ছে, আপনাদের দেখে তো খুব আনন্দ হবে। না, তারা বিসিএস পড়াশোনার জন্য যাচ্ছে। আমি একবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমাদের একটা বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় দরকার এবং সবচেয়ে বেশি ছাত্র-ছাত্রী সেখানে ভর্তি হতো।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এখানে একটা বিবাদ আছে যে, প্রমিত বাংলার সঙ্গে আমাদের রাস্তার একটা বাংলা আছে, "আইতাছি", "যাইতাছি"। সেটাও খারাপ না, আমার কথা হচ্ছে, যেকোনো ধরনের বাংলাই আমরা গ্রহণ করব। আঞ্চলিক ভাষাগুলো এত সুন্দর, সেগুলোর শক্তি ধরে রাখতে হবে। ভাষা একটা বড় সংসারের নাম। ডালপালা বিস্তার করে একটা বড় বট বৃক্ষের মতো ভাষা জিনিসটা। সেই ভাষার যদি আমরা পরিচর্যা না করি, যদি অন্য ভাষা আমাদের ভাষায় ঢুকিয়ে এক ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষায় আমাদের কথাগুলো সেরে নেই, তাহলে আমাদের না ভাষা উন্নত হবে—না সাহিত্য উন্নত হবে।'
সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'প্রায়ই গল্প আমাকে পড়তে হয়। আজকালকার অনেক গল্প পড়ে আমার মনে হয় যে, ভাষার এই বিকৃতি নিয়ে আমি কী করে গল্প লিখি। এমন সমস্ত ভাষা, যেগুলো আপনাদের মুখে বলাটাও কঠিন। সাহিত্যের নামে সব তো চলে না! সংস্কৃতির নামে সব তো চলে না! একটা তো সীমারেখা টানতে হয়। একটা লাল রেখা তো টানতে হয়। এর বাইরে আমাদের যাওয়া উচিত নয়। এই বিষয়গুলো আমি মনে করি আপনারাও চিন্তা করবেন।'
জন্মস্থান হবিগঞ্জের একজনের সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'আমাদের হবিগঞ্জের একজন খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন যে, ঢাকার মতো আমরা হতে পারিনি। আমি বললাম সমস্যাটা আমাদের ওইখানে। আমাদের জেলাগুলো জেলাই থাকুক, মফস্বল মফস্বল থাকুক। প্রান্ত যখন কেন্দ্র হয়, তখন কেন্দ্রের থেকেও খারাপ হয়। এই কিশোরগঞ্জ যদি ঢাকা হয়, ঢাকা থেকেও খারাপ হয়ে যাবে। আপনারা দয়া করে কিশোরগঞ্জকে কিশোরগঞ্জে থাকতে দিন। আমি আমার ছেলে-মেয়েদের বলি, প্রত্যেকের মফস্বলকে তোমরা টিকিয়ে রাখো। মফস্বলের একটা আলাদা সংস্কৃতি আছে। মফস্বলের সবাই সবাইকে চেনা।'
এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেই আগামী বছর কিশোরগঞ্জ যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'আগামী বছর যখন আপনাদের আবার পুরস্কার দেওয়া হবে, আমি চাই আপনারা সেটা কিশোরগঞ্জে দেন। ঢাকার মানুষ কিশোরগঞ্জে যাবে। আমি মনে করি, সেটাই ভালো হবে। তাহলে আমি নিজে যাব আমি কথাও দিচ্ছি আপনাদেরকে যদি বেঁচে থাকি।'
শর্ত জুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, 'যদি আমার সঙ্গে আলতাফ পারভেজ আর আহমদ বশীর যান, আমি শর্ত জুড়িয়ে দিলাম। তাহলে আমরা একসঙ্গে দল বেঁধে যেতে পারি।'
আবু খালেদ পাঠান ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, 'এই পরিবার একটা অন্ধকার সময়ে একটা খুব ভালো কাজ করে যাচ্ছে। অন্ধকার কিন্তু বহুদিন থেকে আমাদের ওপর চেপে বসেছে। অন্ধকারকে আস্তে আস্তে দূর করতে হবে আমাদের। ভালো থাকার এবং আশাবাদী থাকার হুকুম আমাদের এই তরুণ সমাজ দিচ্ছে আমাদেরকে, আমি আশা করি, আমরা সবাই সে আশাবাদটা ধরে রাখবো এবং সাহিত্য সংস্কৃতির মাধ্যমে যে মানুষকে জাগানো যায় এবং শিক্ষার মাধ্যমে সেই বিষয়টা আমরা হয়তো করে দেখাবো সবাই।'


Comments