বিশ্লেষণ

ছাত্ররাজনীতির অগ্নিপরীক্ষা ডাকসু

ducsu
ডাকসু ভবন। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিরল ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবে আগামীকাল মঙ্গলবার—তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম ডাকসু নির্বাচন এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বড় নির্বাচনী পরীক্ষা।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন কলঙ্কিত হয়েছিল ছাত্রলীগের দাপট ও ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগের মধ্য দিয়ে। সে হিসেবে, ১৯৯০ সালের মে মাসের পর এটাই ডাকসুর প্রথম প্রকৃত নির্বাচন।

এবারের ডাকসু নির্বাচনটা কেবল ক্যাম্পাসের একেবারে সাদামাটা কোনো নির্বাচন কিংবা ছাত্র সংসদের পদগুলোর জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না। বরং বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে একপ্রকার গণভোট। সেইসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা, বৈধতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতির এক অগ্নিপরীক্ষা।

এখানে প্রশ্নটা 'কে' জিতবে তারচেয়ে বেশি 'কী' জিতবে সেটা—ছাত্ররাজনীতি কি ভীতিপ্রদর্শন ও আশ্রয় দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হবে, নাকি সেই পুরোনো অবস্থানই আবারও নিঃশব্দে ফিরে আসবে?

দশকের পর দশক ধরে ক্যাম্পাস রাজনীতি হয়ে উঠেছিল দলীয় আনুগত্য, সহিংসতা ও ক্ষমতাসীন দলের তোষণপ্রবণতার প্রতিশব্দ। ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের ভয় দেখানো ও রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস রাজনীতি। যে ছাত্ররাজনীতি একসময় ছিল সক্রিয়তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের প্রাণবন্ত প্ল্যাটফর্ম, তা হয়ে উঠেছে শাসকগোষ্ঠীর কথা প্রতিধ্বনির আরেকটি মাধ্যম। ভয় ও পক্ষপাতিত্বের সংস্কৃতি ক্যাম্পাস জীবনের গণতান্ত্রিক চেতনা শূন্য করে দিয়েছিল।

এরপর আসে জুলাই ২০২৪। বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে দেশজুড়ে এক কঠিন বাস্তবতা হাজির করে। তাদের নয় দফা দাবিতে ছিল দলীয় লেজুরবৃত্তির ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ করার আহ্বান। তাদের এ দাবি ব্যাপক সাড়া ফেলে। কয়েক মাসের মধ্যেই অন্তত ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দলীয় লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটে।

তাই প্রশ্ন জাগে, এবারের ডাকসু কি সেই দাবিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রথম প্রচেষ্টা?

এই নির্বাচন নেতৃত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার নির্বাচন। একইসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীর জন্য এটি ভয়মুক্ত পরিবেশে প্রথম ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা। তাই তো একে বলা যায়, গণতান্ত্রিক এক মাইলফলক।

যে ক্যাম্পাস একসময় ভীতিপ্রদর্শনে নিস্তব্ধ ছিল, সেখানে এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ইশতেহার ও প্রচারণা। দ্য ডেইলি স্টারের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, যাদের অধিকাংশেই সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন পেয়েছে জুলাই আন্দোলনের সামনের সারির নেতারা। এই প্রার্থীরা নতুন প্রজন্মের ছাত্র নেতৃত্বের প্রতীক—যাদের অনেকেই ক্ষমতার প্রতিষ্ঠিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

প্রার্থীরা ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রতিটি অনুষদ, হল, এমনকি আবাসিক এলাকার বাইরেও। শিক্ষার্থীদের তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে প্রত্যেকের ভোটের গুরুত্ব আছে। তাদের প্রচারণায় নেই পেশিশক্তি বা অর্থের দাপট। সেখানে বরং ঠাঁই পেয়েছে নতুন চিন্তা। তাদের দাবি, পাঠ্যক্রম সংস্কার, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন। এই উচ্ছ্বাস অনুভবযোগ্য। বহু বছর পর শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন ভয় থেকে নয়, বরং আশা থেকে।

এই নির্বাচনের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরেও। এরপর আসছে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১১ সেপ্টেম্বর), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (২৫ সেপ্টেম্বর) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১২ অক্টোবর) ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সবগুলোই তিন দশকেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এসব নির্বাচন অনেক আগেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এতদিন পর হওয়ায় উচ্চশিক্ষার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কিন্তু, বাকিগুলোর চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।

ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় প্রতিটি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু—যা এ দেশের মানুষকে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার দিয়েছে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেছে, স্বৈরশাসক তাড়িয়েছে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রাণ দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।

ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা, ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কেন্দ্রে। কিন্তু বহু বছর ধরে সেই ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গিয়েছিল নিষ্ক্রিয়তা ও দলীয়করণের চাপে।

ডাকসুর নেতারাই মুক্তিযুদ্ধের পথে পাকিস্তানপন্থীদের বাদ দিয়ে সব মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরে তারাই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদের সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ২০২৫ সালে ডাকসু ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন কি সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দেবে?

মেয়াদের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে ড. ইউনূসের প্রশাসনের জন্য এই নির্বাচন একটি পরীক্ষা। ডাকসুকে প্রতীকী আয়োজন হিসেবে দেখা যাবে না। এখানে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ভবিষ্যতের জাতীয় নির্বাচনের রূপ দেখাতে পারে। প্রমাণ করতে পারে যে, ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমতায়ন সম্ভব। কিন্তু যদি ভোটের নিরপেক্ষতা ও সততা ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলে তা বাংলাদেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক হতাশার ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে।

এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে নিরপেক্ষতা, বৈধতা ও গণতান্ত্রিক অভিপ্রায় নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এটি শুধু ছাত্র নেতৃত্বের ব্যাপার নয়। অনেকের কাছে এটি একটি ইঙ্গিত যে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ধারা কেমন হবে—বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ও দলীয়-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে।
ডাকসু নির্বাচন সেই জায়গা, যেখানে ছাত্ররাজনীতি নতুন করে জন্ম নিতে পারে। একইসঙ্গে এই নির্বাচনই নির্ধারণ করবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা।

Comments

The Daily Star  | English

Ducsu election sees spontaneous turnout of voters

Ducsu election is being held at eight centres of the campus with nearly 40,000 registered voters and 471 candidates vying for 28 central posts.

1h ago